
ডিমেনশিয়া শব্দটি শুনলেই আমাদের মাথায় প্রথমে আসে স্মৃতিভ্রষ্টতা, পরিচিত জায়গায় হারিয়ে যাওয়া কিংবা কাছের মানুষের নাম ভুলে যাওয়ার মতো উপসর্গ। কিন্তু এই মানসিক অসুস্থতার প্রাথমিক সংকেতগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়, কারণ সেগুলো প্রকাশ পায় সবচেয়ে সাধারণ জায়গাটিতে সাধারণ কথোপকথনের মধ্যে।
হয়তো এক কাপ চায়ের আড্ডা, ফোনে পুরনো বন্ধুর সঙ্গে আলাপ বা পারিবারিক রাতের খাবারের টেবিলে হঠাৎই কিছু অদ্ভুত আচরণ চোখে পড়ে। আপনি ভাবেন, এ তো বয়সের কারণেই হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এগুলোই হতে পারে ডিমেনশিয়ার শুরুটা জানান দেওয়ার কৌশল।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, এমন পাঁচটি সূক্ষ্ম লক্ষণের কথা, যা সাধারণ কথোপকথনের মধ্যেই দেখা দেয় এবং যা প্রায়ই ভুল করে “বয়সের স্বাভাবিক লক্ষণ” বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
বারবার এক কথা বলা কিংবা নির্দিষ্ট শব্দ খুঁজে না পাওয়া
মাঝে মধ্যে “জিহ্বার ডগায়” থাকা শব্দটা মনে না পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু যদি কেউ প্রায়ই “ওই জিনিসটা”, “ওটা”, “সেটা যে…” ইত্যাদি অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করে, তাহলে সেটা দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। যেমন কেউ মাইক্রোওয়েভের কথা বলতে গিয়ে বলে “খাবার গরম করার বাক্সটা” বা “হিট করার জিনিসটা” এটা শুধু ভুলে যাওয়া নয়, বরং পরিচিত শব্দ ব্যবহার করতে না পারার একটা সমস্যা।
আরও একটি লক্ষণ হচ্ছে বারবার একই গল্প বলা। কেউ হয়তো পাঁচ মিনিট আগেই বলা গল্প আবার বলতে শুরু করলেন। আপনি ভদ্রতাবশত হাসেন, হয়তো একটু ঠাট্টাও করেন। কিন্তু মনে মনে ভাবেন এটা কি স্বাভাবিক?
কথার খেই হারিয়ে ফেলা, অতিরিক্ত ফিলার শব্দ ব্যবহার
আপনি সপ্তাহান্তে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছেন, হঠাৎই সেই ব্যক্তি বলে উঠলেন, “তোমাকে কি আমার পাড়ার বিড়ালের গল্প বলেছিলাম?”এটা শুধু খেয়ালি নয়, বরং আলাপচারিতার ধারা অনুসরণ করতে না পারার লক্ষণ হতে পারে।
“উঁ… মানে… তো… এই যে…,”এ রকম ফিলার শব্দ আমরা সবাই ব্যবহার করি। কিন্তু যদি কেউ প্রায় প্রতিটি বাক্যে এ ধরনের শব্দে ভরসা করেন এবং গোছানো বাক্য বলতে কষ্ট হয়, তাহলে বুঝতে হবে ভাষা প্রক্রিয়াকরণে সমস্যা হচ্ছে।
পরিচিত নাম ভুল করা, বারবার একই ভুল
ছেলেকে ভাইয়ের নামে ডাকা বা প্রধানমন্ত্রীকে "টিভির সেই লোকটা" বলা যদি একবার হয়, তাহলে ভুল বলা যায়। কিন্তু বারবার পরিচিত মানুষ কিংবা পরিচিত পেশার নাম গুলিয়ে ফেলাটা ডিমেনশিয়ার সূচক হতে পারে।
হঠাৎ চুপ করে যাওয়া কিংবা বাক্যপথ হারিয়ে ফেলা
কথার মাঝখানে হঠাৎ থেমে যাওয়া, যেন মনের মধ্যে কথাটাই হারিয়ে গেল এটা লক্ষ্যণীয়। অনেক সময় মানুষ হেসে বলেন, “আমি কী বলছিলাম যেন?”, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা আতঙ্কিত ও হতাশ হতে পারেন।
কথোপকথন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া
আগে যারা ছিলেন আড্ডার প্রাণ, এখন হয়তো তারা চুপচাপ বসে থাকেন, চোখে চোখ রাখেন না, শুধু মাথা নাড়েন। অনেকে ভাবেন, উনি হয়তো ক্লান্ত। কিন্তু আসলে, হয়তো তিনি বুঝতে পারছেন না কী বলা হচ্ছে বা কীভাবে উত্তর দেবেন। ভুল বলার ভয়ে, নিজের অক্ষমতা ঢাকতে চুপ করে থাকেন।
কেন এই সূক্ষ্ম লক্ষণগুলো গুরুত্বপূর্ণ
ডিমেনশিয়ার শুরুটা সবসময় নাটকীয় নয়। অনেক সময় এটা প্রকাশ পায় যখন আমাদের মস্তিষ্ক ভাষা, স্মৃতি, আবেগ, ধারা ও বিশ্লেষণক্ষমতা নিয়ে হিমশিম খায়। আলাপচারিতা কেবল শব্দের আদান-প্রদান নয়; এর সঙ্গে জড়িত চিন্তা, পরিকল্পনা, অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া।
দুঃখজনকভাবে, অধিকাংশ সময় এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো “বয়সের স্বাভাবিক অংশ” বলে অবহেলা করা হয়। কিন্তু এই প্রথম দিকের লক্ষণগুলো শনাক্ত করা গেলে পরিবারগুলো আগেভাগে প্রস্তুতি নিতে পারে, উপযুক্ত চিকিৎসা ও সহযোগিতা পাওয়া যায় এবং সবচেয়ে বড় কথা, রোগীকে ভালোভাবে বোঝা ও সহানুভূতির সঙ্গে পাশে থাকা যায়।
যদি এই লক্ষণগুলো চোখে পড়ে, কী করবেন?
আতঙ্কিত হবেন না। দু-একবার এমন কিছু হওয়া মানেই ডিমেনশিয়া নয়। কিন্তু যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে এমন ঘটতে থাকে, তাহলে সেটা লক্ষ্য রাখা জরুরি।
নোট রাখুন। কী কী পরিবর্তন দেখেছেন, কতবার এমন হয়েছে—এসব লিখে রাখলে চিকিৎসকের কাছে বোঝাতে সুবিধা হয়।
স্নেহভরে কথা বলুন। ঘনিষ্ঠ কেউ হলে তাকে বলুন, “আমি কিছু জিনিস লক্ষ্য করেছি, তোমার ভালো থাকাটা নিয়ে ভাবছি।”
ডাক্তারের পরামর্শ নিন। অনেক সময় স্ট্রেস, ভিটামিন ঘাটতি বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও এমন আচরণ ঘটাতে পারে। তাই মেডিকেল চেকআপ করানো উচিত।
সহযোগী হোন। মনে রাখবেন, ডিমেনশিয়ার শুরুর দিকেই রোগী বুঝতে পারেন যে কিছু একটা ঠিক নেই। সেক্ষেত্রে ভয় বা লজ্জার চেয়ে দরকার সহানুভূতি ও ধৈর্য।
কথাই বলে, ডিমেনশিয়া চিৎকার করে আসে না নীরবে আসে
এই অসুস্থতা অনেক সময় প্রথম জানিয়ে দেয় আমাদের নিত্য আলাপচারিতার মধ্যেই। তাই পরেরবার যখন মায়ের সঙ্গে গল্প করবেন, বাবার সঙ্গে হাঁটতে যাবেন, বা মধ্যবয়সী কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলবেন, একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন। হয়তো আপনি এমন কিছু ধরতে পারবেন, যা এখন ছোট মনে হলেও ভবিষ্যতের জন্য বড় দিকনির্দেশক হতে পারে।
ডিমেনশিয়ার মতো রোগ যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে, তত দ্রুত সাহায্য পাওয়া যায়। আর সেজন্য সচেতন থাকা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষাই সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।
সূত্র:https://tinyurl.com/yc8dukkj
আফরোজা