
কোরবানির পশুর চামড়া লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রাখা হচ্ছে
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর এলাকায় মহাসড়কের পাশে ব্যবসায়ীদের স্তুূপ করে রাখা বিপুল পরিমাণ কোরবানির পশুর চামড়ার দুর্গন্ধে পরিবেশ দূষিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ঈদের পর থেকে চামড়ার গন্ধে অস্থির ওই এলাকার মানুষ। পথচারিরাও চলছেন নাকে রুমাল দিয়ে। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, মহাসড়কের পাশে খোলা আকাশের নিচে চামড়ার স্তুূপ রাখার সুযোগ নেই। তবে খোলা আকাশের নিচেই চলছে চামড়ার কারবার। উপজেলার বেলপুকর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোরবানির পশুর চামড়া খোলা আকাশের নিচে লবণজাত করে রাখা হয়েছে। কিছু চামড়া যত্রতত্রভাবে মহাসড়কের পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। এতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
এই সড়কে চলাচল করা মানুষ নাকে কাপড় বা রুমাল দিয়ে চলাচল করছেন। তাদের অভিযোগ ঈদের পর থেকে চামড়ার দুর্গন্ধে ওই সড়কে চলাচল করা দায় হয়ে পড়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, এখানে চামড়ায় লবণজাত করা হচ্ছে। দ্র্রুত সময়ের মধ্যে সড়কের পাশে পড়ে থাকা এসব চামড়া সরিয়ে নেওয়া হবে।
জানা গেছে, রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের পাশে বেলপুকুর এলাকায় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর চামড়ার আড়ত রয়েছে। তারা জেলার সিংহভাগ কোরবানির পশুর চামড়া কিনেছেন। চামড়াগুলো তাদের গোডাউন ছাড়াও খোলা আকাশের নিচে স্তুূপ করে রেখেছেন। ঈদের পর থেকে এখনও চামড়ায় লবণজাত করছেন। এতে পুরো এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম নূর হোসেন বলেন, খোলা আকাশের নিচে চামড়া রাখার সুযোগ নেই। এটা রাখতে পারবে না। এ দিকে রাজশাহীতে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম না পেয়ে অনেকেই ফেলে দিয়েছেন।
গরুর চামড়ার দাম গত বছর ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হলেও এবার তা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার ওপরে কেউ কেনেনি। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ধরাশায়ী হয়েছেন। ঈদের দিন বিকেলে এক দিনের চামড়ার হাট বসে পুঠিয়া উপজেলা সদরে। এখানে আলী হোসেন নামের এক মৌসুমি ব্যবসায়ী ২০টি গরুর চামড়া কিনেছেন ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা দরে। কিন্তু বিক্রি করেছেন ৪০০ টাকা করে। আলী হোসেন বলেন, বেশি দামে চামড়া কিনে তিনি ধরা খেয়েছেন।
চামড়ার স্থানীয় পাইকার ক্রেতা আব্দুল ওয়াহাব বলেন, এবার লবণের দাম অনেক বেড়ে গেছে। তীব্র গরমে চামড়ার মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সরকার চামড়ার বেশি দাম ধরে দিলেও বাজারে দাম কম। রিাজশাহী জেলা চামড়া সমিতির নেতৃবৃন্দের দাবি, এবার চামড়া কেনা ও সাময়িক সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে লবণ অনুদান দিয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু সেই লবণ সমিতিভুক্ত ব্যবসায়ীরা সবাই পায়নি। মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোকে বেশি পরিমাণ লবণ দেওয়া হয়েছিল। ফলে ব্যবসায়ীরা তেমন উপকৃত হয়নি।
রাজশাহী চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আসাদুজ্জামান মাসুদ বলেন, গরুর চামড়া কোথাও কোথাও ৭০০ টাকা পর্যন্ত কেনা-বেচা হয়েছে। খাসি বা বকরি ও ভেড়ার চামড়া সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ টাকা করে কেনা-বেচা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী থেকে জানান, দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকার কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে হলো মাত্র ৩০০ টাকায়। আমার পাশের প্রতিবেশী আনছার আলী ভাই ৭০ হাজার টাকা কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করলেন ওই ৩০০ টাকায়। আবার ২৮ হাজার খাসি ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে হলো ১০ টাকায়, পাশের আরেক প্রতিবেশী ১৩ হাজার টাকার ছাগলের চামড়া বিক্রি করলো ওই ১০ টাকায়। ভাইরে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দামে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরেও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের কোনো কার্যকর নেই। ঠিক এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর জাকির হোসেন।
নীলফামারীর বড় বাজার মোড়ে গিয়ে দেখা গেলো একই অবস্থা। গরু ৩০০ ছাগল ১০ টাকা। চামড়ার বারো অবস্থা বাহে-কথাটি বাড়াইপাড়া মহল্লার সাবদার আলীর। মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন আমরা ভেবেছিলাম এইবার নীলফামারীতে ২ লাখ পশু কোরবানি হবে। সেখানে ঈদের দিন পর্যন্ত পশু কোরবানি হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার। অনেকে চামড়াই বিক্রি করতে পারেনি। আমরা যে কাঁচা চামড়াগুলো ক্রয় করেছি তা লবণ দিয়ে রাখতে হচ্ছে। স্থানীয় মহাজনরা কাঁচা চামড়া নিচ্ছেন না। লবণের দামও চড়া। মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী আজগর আলীর ভাষায় শেষ মেষ এই চামড়া ক্রয় করে আমাদেরও লোকসান গুনতে হয় কি না কে জানে।
মুসল্লি জব্বার আলী বললেন ১০ টাকার ছাগলের চামড়া বেঁচে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভিক্ষুককে দিতে গেলে সে ১০ টাকা নিতে চায়নি। বাধ্য হয়ে পকেট থেকে আরও ৪০ টাকা যোগ করে দিতে হলো ৫০ টাকা । আরেকজন মুসল্লি মানিক মিয়া বললেন গরুর চামড়া বিক্রি করেছি ৩০০ টাকা। তিনজন ফকির এসে একশ’ টাকা করে তিনশ’ টাকা নিয়ে চলে গেল। এখনও চামড়ার টাকার জন্য মানুষজন আসছে। বাধ্য হয়ে পকেট থেকে আরও এক হাজার টাকা বের করে দিতে হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে পাওনা টাকা চেয়ে বারবার তাগিদ দিয়েও ঢাকার ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি তারা। এতে তারা চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন, যে কারণে তাদের পক্ষে চামড়া কেনা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
নীলফামারী জেলার চামড়ার বড় বাজার সৈয়দপুরে গরুর চামড়া ৩০০ ও ছাগলের চামড়া ৫০ থেকে ১০ টাকা পিস দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এসব চামড়া নাটোর ও রংপুর জেলার আড়তগুলোতে বাকিতে বিক্রি করতে হচ্ছে, ফলে নগদ অর্থের সঞ্চালন ঘটছে না।
চামড়া ব্যবসায়ী গুলজার রহমান বললেন, এক সময় সৈয়দপুরে শতাধিক ব্যবসায়ী চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের পাওনা টাকা না পেয়ে পুঁজি হারিয়ে অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে মাত্র সাত-আটজন ব্যবসায়ী টিকে রয়েছেন, তারাও পুঁজি আটকে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছেন। ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা বিদেশে চামড়া রপ্তানি বন্ধ থাকার অজুহাত দেখিয়ে পাওনা পরিশোধ করছেন না বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
সৈয়দপুর চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও মেসার্স আল-আমিন ট্রেডার্সের মালিক আজিজুল হক জানান, ঢাকার ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছে সৈয়দপুরের ব্যবসায়ীদের ১ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। আমার নিজের ২০ লাখ টাকা আটকে আছে। দীর্ঘদিনেও সেই টাকা পরিশোধ করা হয়নি। টাকা চাইলে তারা বলেন, বিদেশে চামড়া বিক্রি নেই, তাই দিতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, আমরা যদি চামড়া না কিনি, তাহলে এর দরপতন ঘটবে এবং বিক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
স্টাফ রিপোর্টার, ঈশ^রদী, পাবনা থেকে জানান, ঈশ^রদীতে চামড়ার আড়ৎদার, ব্যবসায়ী, ফরিয়া ও কোরবানির চামড়া বিক্রেতাদের ব্যাপক ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে। পশু কোরবানির পরিমাণ গতবারের তুলনায় স¦াভাবিক থাকলেও দাম ঠিক না থাকায় ক্রেতা বিক্রেতাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সরকার ছাগলের চামড়া ২০-২৫ টাকা ফুট এবং গরুর চামড়া ৫৫ টাকা থেকে ৬০ টাকা ফুট হিসেবে চামড়া ক্রয়ের দাম নির্ধারণ কওে দেয়। বিক্রির স্থান ও দাম নির্ধারণ করে না দেওয়ায় স্থানীয় বাজারে ক্রয়বিক্রয়ে মূলত: সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এবার ঈশ^রদীতে ছাগলের চামড়া ৪০-৫০ টাকা এবং গরুর চামড়া ৭’শ-১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এ কারণে অনেকেই কাক্সিক্ষত দাম না পেয়ে মাদ্রাসায় ও এতিম খানায় চামড়া দান করেছেন। ফরিয়ারা অভিযোগ করেছে বলেন, গ্রাম থেকে বেশি দামে চামড়া কিনে এনে কম দামে বিক্রি করে লোকসানের শিকার হতে হয়েছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা, মাগুরা থেকে জানান, ঈদুল আজহার কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারের দাম এবছরও কম। এখানে প্রতিটি গরুর কাঁচা চামড়া লবণবিহীন প্রকার ভেদে ৩শ’ টাকা থেকে ৮শ’ টাকা এবং খাসির চামড়া ১০ টাকা থেকে ৫০/৬০ দরে বিক্রি হচ্ছে তবে ছোট ছাগলেরর চামড়া কেউ ক্রয় করেন নি। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এবারও চামড়া ক্রয় করে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। এ দিকে আড়তে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ দিকে কোরবানির চামড়ার বাজারে লবণবিহীন কাঁচা গরুর চামড়া প্রতিটি প্রকার ভেদে ৩শ’ টাকা ৭/৮শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
গত বছর এই চামড়া ৩শ’ টাকা থেকে ৬শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। খাসির চামড়া ১০ টাকা খেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ছোট ছাগলের চামড়ার দাম নেই। কেউ ক্রয় করতে চায়নি। তবে চামড়ার আড়তদার ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা প্রতিটি গরুর চামড়া প্রকার ভেদে ৫শ’ টাকা থেকে ১১/১২শ’ টাকা এবং খাসির চামড়া ১০ টাকা থেকে ১২০ টাকা দরে ক্রয় করছেন। চামড়া সংরক্ষণ করতে প্রতিটি চামড়ায় ৮/১০ কেজি লবণ লাগে। অনেকে গরু ও ছাগলের চামড়া মাদ্রাসায় দিয়ে দিয়েছেন। মাগুরার চামড়ার আড়ত ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াহাব বলেন, এ বছর চামড়ার দাম কিছুটা বেশি। প্রতিটি গরুর চামড়া প্রকার ভেদে ৫শ’ টাকা থেকে ১১/১২শ’ টাকা এবং খাসির চামড়া ১০ টাকা ১২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।