ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

তালপাতার পাখা শিল্পীর রং তুলির ক্যানভাস

গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বগুড়ার তিন গ্রাম

মাহমুদুল আলম নয়ন

প্রকাশিত: ০১:০৫, ১১ জুন ২০২৫

গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বগুড়ার তিন গ্রাম

বগুড়ার কাহালু উপজেলায় তালের পাখা তৈরিতে ব্যস্ত শিল্পীরা

ধান কাটা হয়েছে সবেমাত্র। পাকা রাস্তার সামনে দিগন্ত বিস্তৃত খোলামাঠ। রোদ বৃষ্টির লুকোচুরিতে বাতাসের এলোমেলে ছুটে চলার অনুভব। প্রত্যন্ত গ্রামের এই পাকা রাস্তা ধরে নামলেই সরুপথ। পাখা তৈরির গ্রাম। সাধারণ আর দশটা গ্রামের মতো মনে হলেও এখানকার নারী পুরুষদের কাজ গ্রামটিকে পৃথক করে করে তুলেছে। আড়োলা আতালপাড়া। এ রকম আরও ২টি গ্রামের পরিচয় একই। তা হলো তালপাতার পাখার গ্রাম।

পাখার গ্রাম হিসাবে সবার নিকট পরিচিত বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা আতালপাড়া পূর্ব ও উত্তর পাড়া এবং যোগীর ভবন গ্রাম। গ্রীষ্মের দাবদাহে ঘর্মাক্ত শরীরকে প্রশান্তির পরশ ছুঁইয়ে দিতে বগুড়ার কাহালু উপজেলার এই গ্রামগুলোতে তৈরি হয় তালের পাখা। তালের পাখা গ্রামীণ বাংলার এক অহংকারী ঐতিহ্য।বগুড়ার প্রত্যন্ত এলাকার এই জনপদ গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনকার নারী-পুরুষরা বংশপরম্পরায় শৈল্পিক নান্দনিকতায় ধরে রেখেছেন রকমারি তালের পাখা তৈরির প্রশান্তির সৌন্দর্য্য।

সময়ের প্রয়োজনে তালের পাখার চাহিদা কমতে থাকলেও এসব গ্রামের কর্মীদের পাখা তৈরির কারুকার্যে প্রভাব ফেলেনি। কপালের ঘাম মুছে তারা অবিরাম স্বপ্ন বোনার মতো ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে তৈরি করে চলেছেন শিল্পীর নিপুণতায় তালপাতার পাখা। রং তুলির  ছোঁয়ায় একটি পাখা,শুধু যেন একটি পাখা নয়, হয়ে উঠে  শিকড়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গ, যা চিরায়ত বাংলার ছবি হয়ে ডানা মেলে স্বপ্ন ছড়ায়।
হাত পাখার প্রচলন প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতার প্রচলন প্রায় ৩ হাজার বছর হলেও জাপান ও চীনের তৈরি নান্দনিক হাতপাখা এক সময় ইউরোপের বণিকদের নিকট অন্যতম আগ্রহের পণ্য ছিল। হাতপাখার মধ্যে হাতলওয়ালা পাখা ছাড়াও দড়ি টানা পাখা আভিজাত্যের প্রতিক ছিল। আর রাজাবাদশার দরবার বা জমিদারি মহল ও মর্যদাভেদে ধনিক শ্রেণির লোকজনের মূল্যবান পাথর ও নকশাখচিত হাত ও দড়িটানা পাখার ব্যবহার আভিজাত্যেই উঠে আসত এক সময়। এসব পাখা ছিল নানা মূল্যবান পাথর ও বাহারি নকশাখচিত।

তবে বাঙালির তালপাতার পাখা একেবারে নিজস্ব ঐতিহ্য। অতিথির সমাদরে বা বাইরে থেকে কেউ ঘর্মাক্ত দেহে বাড়িতে আসলেই তালপাখা এগিয়ে দেওয়া অতি স্বাভাবিক আচার। বিয়ে থেকে সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তালপাতার পাখা বা সুঁই-সুতোর ফোঁড়ে কাপড়ের তৈরি হাতপাখার ব্যবহার ছিল অবিচ্ছেদ্য। সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনের উপকরণ পাল্টেছে। এখন বৈদ্যুতিক পাখা ও এসি শহুরে জীবনযাত্রায় অংশ হয়ে দাঁড়ালেও বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে এখনো অনেকের কাছে গরমে বিশ্বস্ত সঙ্গীর নাম তালপাখা। বিদ্যুতের লোডশেড বা যে কোনো বৈদ্যুতিক কারণে বৈদ্যুতিক পাখা বা এসি অকেজো হলেও হাঁসফাঁস গরম থেকে প্রশান্তি ছোঁয়া পেতে তালপাতার জুড়ি নেই।

বিদ্যুতের গোলমেলে অবস্থায় তালপাখা থাকলে চিন্তা থাকে না। হাত ঘুরালেই শীতল বাতাস। এই তালপাখার কারিগররা কিন্তু গ্রীষ্মের তপ্ত সময় উপেক্ষা করে অন্যকে প্রশান্তি দিতে পাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন। বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাখা তৈরির গ্রামগুলোতে তালপাতার ঘুরনি বা চরকি, পকেট ও ডাঁটি বা হাতল পাখা তৈরি করেন কারিগররা। ফাল্গুন থেকে শুরু হয়ে চৈত্র বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ এবং ভাদ্রের তালপাকা গরম পর্যন্ত এই তালপাতার তৈরি পাখার চাহিদা থাকে। তবে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে চাহিদা থেমে যায় বলেই জানান কারিগররা। তবে চৈত্র বৈশাখ মাসের মতোই ভাদ্র মাসে পাখার চাহিদা থাকে বেশ।
তালের পাখা তৈরির গ্রামগুলোতে বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই আবার পাখা তৈরির শিল্পী। এই শিল্পে বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই সময় দেন। কেউ তালের পাতা কাটেন, কেউ পাখার জন্য বাঁশ কাটেন, কেউ বা বাঁেশর সরু ফালি, ডাট ও ঘুরানোর জন্য গোলাকার হাতল তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন। আর কেউ বা পাখা তৈরির পর রং তুলির ছোঁয়ায় গ্রামীণ দৃশ্য থেকে শুরু করে নানা ছবি তুলে আনেন পাখার ক্যানভাসে। মৌসুমের সময় সবাই পাখা তৈরির শিল্প তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন। প্রকার ভেদে ১২শ’ থেকে ৪ হাজার টাকায় প্রতিশ’ পাখা তৈরি হয়। চাহিদা অনুযায়ী এর দাম ওঠা নামা করে।

তালপাতার পাখা তৈরিতে যথেষ্ট সময় দিতে হয়। শীতের সময় থেকে এসব গ্রামে পাখা তৈরির উপকরণ প্রস্তুতের কার্যক্রম শুরু হয়। তালের পাতা কেটে প্রথমে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরে তা পরিষ্কার করে ধরন অনুযায়ী কাটতে হয়। এরপর সুঁই-সুতো বাঁশের ফালির রিং ও হাতল লাগানোর পর রং তুলির আঁচড়। তবে তালের হাতলওয়ালা পাখায় আবার বাঁশের তৈরি হাতল লাগানো হয় না।
আতালপাড়া উত্তর পাড়া গ্রামের মনোয়ারা বেগমের মাটির তৈরি ঘরের বারান্দায় পকেট বা ভাঁজ করা পাখা স্তূপাকার করে রাখা। তালের পাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাখা তৈরির শেষ পর্যায়ে তিনি একাগ্রতায় পাখার ক্যানভাসে রং তুলির ছোঁয়া পরিপূর্ণ করে তুলছিলেন তালপাতার পাখার   সৌন্দর্য। জানালেন তাদের গ্রামে প্রায় ৩ শতাধিক নারী-পুরুষ পাখা তৈরি করেন। তিনি তৈরি করছেন ২৩/২৪ বছর ধরে। স্বামী প্রবাসী। জানালেন নিজের উপার্জনের জোরই আলাদা। তাই পাখা তৈরি করেন। বিক্রি করার জন্য বেগ পেতে হয় না। পাইকাররা এসে বাড়ি থেকেই কিনে নেন। জানালেন চৈত্র বৈশাখ মাসে চাহিদা থাকলেও এবার জ্যৈষ্ঠ মাসে আগের মতো চাহিদা নেই।

ঘরে প্রায় দেড় হাজার পাখা তৈরি রয়েছে। গ্রামের ভেতর একটু ঢুকলেই আরেক বাড়ি। সাবিনা খাতুন ও বৃদ্ধ মা সুফিয়া বেগম। পাখা   তৈরির জন্য তালের পাখা ছাঁটাসহ পকেট পাখার হাতল তৈরির জন্য বাঁেশর ফালি তৈরি করছেন। জানালেন পাখা তৈরির তালের পাতা ব্যবসায়ীরা ট্রাক ভর্তি করে দিয়ে যান। ট্রাক ভেদে ২০/২২ হাজার টাকার পাতা কেনে শীত মৌসুমে। আয়শা সিদ্দীকীর নতুন বউ হয়ে শ^শুর বাড়িতে আসার ৭/৮ মাস হয়েছে। জানালেন শ^শুর-শাশুড়িসহ তিনি পাখা তৈরির কাজ করেন।শ^শুর বাড়িতে আসার পর বাড়ির লোকজনের নিকট থেকে পাখা তৈরি করতে শিখেছেন।

পরিবারের ৩ সদস্য মিলে প্রতিদিন ২শ’ পাখা তৈরি করেন। আড়োলা আতালপাড়ার রাজু পাইকার, স্ত্রী ২ ছেলে ও ছেলের বউ মিলিয়ে সংসারের ৫ জন সবাই পাখা তৈরি করেন। জানালেন বাপ-দাদারা পাখা তৈরি করতেন। এখন তারা পাখা তৈরি করছেন। আড়োলার ২টি গ্রাম এবং যোগীর ভবন গ্রামে পাকা তৈরি হয় বেশি। প্রতিটি গ্রামে ভিন্ন ধরনের তালের পাখা তৈরি হয়। পকেট পাখা বা ভাঁজ করা পাখার গ্রাম পার হলেই চোখে পড়বে চরকি বা ঘুরানি পাখা তৈরির গ্রাম। পাখার হাতলে ঘোরানোর ব্যবস্থা থাকায় এই নাম। হাতলের এই অংশে প্লাস্টিকের পাইপ বা পাইপের মতো বাঁশের তৈরি হাতল থাকে। বাড়ির উঠানে জাহিদুল- রাবেয়া দম্পতির ছেলে রিফাত পাখার জন্য বাঁশের চিকন ফালি তৈরি করছেন। এটি পাখার চারধারে গোল করে বসানোর পর পাখার চারদিক ছেটে পাখা তৈরি করেন তারা। জানালেন বাড়ির সবাই মিলে তারা পাথা তৈরি করেন।

১২ থেকে ১৫ টাকা পিস হিসাবে পাইকাররা কিনে নিয়ে যান। যোগীর পাড়া গ্রামের বাদল মোহন্ত মাস্টার্স পাস করে চাকরির অপেক্ষায় রয়েছেন। জানালেন তারা বংশপরম্পরায় পাখা তৈরি করেন। তাদের গ্রামে তালের ডাটের হাতলওয়ালা পাখা তৈরি হয়। এক একটি পাখা ২৮ থেকে চাহিদা অনুযায়ী ৪০ টাকায় বিক্রি করেন। জনালেন, ও বাবা-মাসহ ছোট ভাইকে নিয়ে তাদের পরিবার। সকলেই তালপাতার পাখা তৈরি করেন। শীত মৌসুমে তারা পাখা তৈরির উপকরণ ও প্রস্তুতি নেন। ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরি ও বিক্রি শুরু হয়। উত্তর ও দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা রাজধানী ছাড়াও সিলেট এলাকায় তাদের গ্রামগুলো থেকে তৈরি পাখা পাইকাররা কিনে নিয়ে যান। যোগীর পাড়া গ্রামের প্রায় ৭০টি পরিবার এই পাখা তৈরির কাজ করেন।

আগে তাদের বাড়িতে ২০/২৫ হাজার পাখা তৈরি করতেন সবাই মিলে। এখন তৈরি হয় ১২/১৪ হাজার। নওগাঁসহ আশপাশের এলাকায় যেখানে তালগাছ বেশি, সেখানকার ব্যবসায়ীরা এলাকার  বাড়ি বাড়ি গিয়ে  তালপাতা সংগ্রহ করেন। প্রতিশ’ তালপাতা ৩/৪শ’ থেকে ১২শ’ টাকায় কেনেন তারা।  এরপর পাখা তৈরির পালা। কারিগররা শিল্পীর নৈপুণ্যে সুঁই- সুতো দিয়ে  তৈরি করেন তালপাতার পাখা। রং তুলি দিয়ে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তালপাতার ক্যানভাসে আঁকেন নানা চিত্রকর্ম।

×