ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

“ওস্তাদ, টান দিয়েন না, বাইজা গেছে”

সোহাগ খান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ১৩:২০, ৮ জুন ২০২৫

“ওস্তাদ, টান দিয়েন না, বাইজা গেছে”

প্রতীকী ছবি

“ওস্তাদ, টান দিয়েন না, বাইজা গেছে”—বাঁচার এই শেষ আকুতি ছিল একজন সহকারীর, যে চেষ্টা করছিল চালককে থামাতে। কিন্তু সব অনুরোধ আর আর্তনাদ যেন কানেই তুললেন না তিনি। মুহূর্ত পরেই বাসের পেছনের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে প্রাণ গেল একজন অসহায় অটোরিকশাচালকের—নাম তার শিপন হোসেন। বয়স মাত্র ৩৪।

শনিবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা হিজলতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা। বাসটি ছিল ভাঙ্গাগামী, তবে চালক এমনভাবে বাস চালাচ্ছিলেন যেন রাস্তায় কারও অস্তিত্বই নেই।
শিপন হোসেন ছিলেন রাজধানীর জুরাইন এলাকার বাসিন্দা। তাঁর স্ত্রী ও সন্তান এখন এক অসহনীয় বাস্তবতার মুখোমুখি।

দায়িত্বহীনতার নির্মম পরিণতি

ঘটনার সময় অটোরিকশায় ছিলেন যাত্রী রাজ হোসেন। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অটোরিকশাটি সার্ভিস লেনে যাচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে বাস এসে চাপ দেয়, চাকা আটকে যায়। শিপন ভাই বারবার বাস থামাতে বলছিলেন। এমনকি বাসে উঠে চালককে থামানোর অনুরোধও করেন। কিন্তু চালক ছিলেন যেন নিজের জগতে। একটুও না থেমে তিনি বাস টান দেন।”

বাসের টানে অটোরিকশা দু’টুকরো হয়ে যায়। শিপন যখন নামার চেষ্টা করছিলেন, তখন সার্ভিস লেনের বিভাজকে পা রাখতেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান বাসের চাকার নিচে। পেছনের চাকাই তাঁর পা ও বুকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যায়।

সাহায্য করতে গিয়ে ব্যর্থ সবাই

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দা মো. সাব্বির বলেন, “আমরা সবাই চিৎকার করে বাস থামাতে বলি। চালকের সহকারীও বলে ওঠেন, ‘ওস্তাদ, বাইজা গেছে, টান দিয়েন না।’ কিন্তু চালক কারও কথা শুনলেন না। যেন একটা মানুষের জীবনের চেয়ে তাঁর গন্তব্য বেশি জরুরি ছিল।”

দুর্ঘটনার সময় সেখানে ছিলেন মোটরসাইকেল আরোহী শাহীন আলম। তিনি বলেন, “বাস থামানোর জন্য আমরা মোটরসাইকেল দিয়ে ধাওয়া করি। পরে বাসের সামনে বাইক রেখে পথ আটকাই। তখন চালক ও সহকারী বাস থেকে নেমে পালিয়ে যান।”

আইনের জালে ধরাছোঁয়ার বাইরে চালক

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক পীযূষ রায় জানান, বাসটি আটক করা হয়েছে। চালক ও সহকারী পালিয়ে গেছেন, তাদের ধরতে অভিযান চলছে।
এই একটি ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আমাদের সড়ক যেন দিনকে দিন রক্তে রঞ্জিত মৃত্যুর মাঠে পরিণত হচ্ছে। একজন মানুষের প্রাণ গেল—যার ঘরে অপেক্ষা করছিল পরিবার। আর অপরাধী? তারা দিব্যি গা ঢাকা দিয়ে আছে।

শেষ প্রশ্ন: আর কত প্রাণ গেলে থামবে এই বেপরোয়া চালনা?

সড়কে চলা এই দায়হীনতা, অবহেলা আর নিষ্ঠুরতা রোধে যখনই কিছু ঘটনা সামনে আসে, তখন সবার মুখে একটাই প্রশ্ন—“আর কত?”
শিপনের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, শুধু আইন থাকলেই হয় না। দরকার সচেতনতা, মানবিকতা এবং কঠোর প্রয়োগ।

মুমু

×