ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কোরবানীর পশুর কাঁচা চামড়ার দামে সিন্ডিকেট

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী

প্রকাশিত: ১৫:৪১, ৮ জুন ২০২৫

কোরবানীর পশুর কাঁচা চামড়ার দামে সিন্ডিকেট

এক কথা এক দাম, দিলে দেন ,না দিলে গেলাম। দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকার কোরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি করতে হলো মাত্র ৩০০ টাকায়। আমার পাশের প্রতিবেশী আনছার আলী ভাই ৭০ হাজার টাকা কোরবানীর গরুর চামড়া বিক্রি করলেন ওই ৩০০ টাকায়। আবার ২৮ হাজার খাসি ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে হলো ৫০ টাকায়, পাশের আরেক প্রতিবেশী ১৩ হাজার টাকার ছাগলের চামড়া বিক্রি করলো ১০ টাকায়। ভাইরে কোরবানীর পশুর চামড়ার দামে সিন্ডিকেট তৈরী হয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কি দোষ দিবো। ট্যানারী মালিক আর বড় মহাজনরা যে দর ঠিক করে দিয়েছে সেই দরেই মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনছে। এতে সরকারের বেঁধে দেয়া দামের কোন কার্যকর নাই। ঠিক এ ভাবেই কথা গুলো বলছিলেন নীলফামারীর জাকির হোসেন।


নীলফামারীর বড় বাজার মোড়ে গিয়ে দেখা গেলো একই অবস্থা। গরু ৩০০ ছাগল ১০ টাকা। চামড়ার বারো অবস্থা বাহে- কথাটি বাড়াইপাড়া মহল্লার সাবদার আলীর।  মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন আমরা ভেবেছিলেন এইবার নীলফামারীতে ২ লাখ পশু কোরবানী হবে। সেখানে ঈদের দিন পর্যন্ত পশু কোরবানী হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার। অনেকে চামড়াই বিক্রি করতে পারেনি। আমরা যে কাঁচা চামড়াগুলো ক্রয় করেছি তা লবণ দিয়ে রাখতে হচ্ছে। স্থানীয় মহাজনরা কাঁচা চামড়া নিচ্ছেন না। লবণের দামও চড়া। মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী আজগর আলীর ভাষায় শেষ মেষ এই চামড়া ক্রয় করে আমাদেরও লোকসান গুনতে হয় কি না কে জানে।
এদিকে মুসল্লিরা বলছেন, একটি গতবাধা কথা সবার মুখে,ঢাকার ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছে নীলফামারীর  চামড়া ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি  টাকা পাওনা রয়েছে। পাওনা টাকা না পাওয়ায় পুঁজির সংকটে পড়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কথাটা কতখানি সত্য একটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এই কথা ছড়িয়ে দিয়ে ফায়দা তোলা হচ্ছে। আর চামড়া বেচা অর্থ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এতিম, অসহায় গরীব দুখি মানুষজনকে। এক মুসল্লি জব্বার আলী বললেন ১০টার ছাগলের চামড়া বেঁচে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভিক্ষুককে দিতে গেলে সে ১০ টাকা নিতে চায়নি। বাধ্য হয়ে পকেট থেকে আরও ৪০ টাকা যোগ করে ৫০ টাকা দিতে হলো। আরেকজন মুসল্লি মানিক মিয়া বললেন গরুর চামড়া বিক্রি করেছি ৩০০ টাকা। তিনজন ফকির এসে একশত টাকা করে তিনশত টাকা নিয়ে চলে গেল। এখনও চামড়ার টাকার জন্য মানুষজন আসছে। বাধ্য হয়ে পকেট থেকে আরও এক হাজার বের করে দিতে হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে পাওনা টাকা চেয়ে বারবার তাগিদ দিয়েও ঢাকার ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি তারা। এতে তারা চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন, যে কারণে তাদের পক্ষে চামড়া কেনা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
নীলফামারী জেলার চামড়ার বড় বাজার সৈয়দপুরের স্থানীয় বাজারে গরুর চামড়া ৩০০  ও ছাগলের চামড়া ৫০ থেকে ১০ টাকা পিচ দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এসব চামড়া নাটোর ও রংপুর জেলার আড়তগুলোতে বাকিতে বিক্রি করতে হচ্ছে, ফলে নগদ অর্থের সঞ্চালন ঘটছে না।
চামড়া ব্যবসায়ী গুলজার রহমান বললেন এক সময় সৈয়দপুরে শতাধিক ব্যবসায়ী চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের পাওনা টাকা না পেয়ে পুঁজি হারিয়ে অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে মাত্র সাত-আটজন ব্যবসায়ী টিকে রয়েছেন, তারাও পুঁজি আটকে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছেন। ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা বিদেশে চামড়া রপ্তানি বন্ধ থাকার অজুহাত দেখিয়ে পাওনা পরিশোধ করছেন না বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।


সৈয়দপুর শহরের গোলাহাট এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী মো. মমতাজ বলেন, ঢাকার পোস্তগালা আড়তে আমার ৩০ লাখ টাকা আটকে আছে। দুই বছর ধরে চেষ্টা করেও টাকা পাইনি। এ অবস্থায় নিজ পুঁজিতে চামড়া কেনা সম্ভব নয়। আড়তদাররাও পুঁজি দেননি, তাই অনেকেই চামড়া কেনেননি।


তিনি বলেন,কাঁচা চামড়া সংগ্রহের পর লবণ দিয়ে ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হয়। কোম্পানিগুলো বেশি দামে চামড়া কেনে না। আমার মনে হচ্ছে না এবার ব্যবসা ভালো হবে।' বলেন, 'এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে না কোম্পানিগুলো আমাদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কিনবে।'সৈয়দপুর চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও মেসার্স আল-আমিন ট্রেডার্সের মালিক আজিজুল হক জানান, ঢাকার ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছে সৈয়দপুরের ব্যবসায়ীদের ১ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। আমার নিজের ২০ লাখ টাকা আটকে আছে। দীর্ঘদিনেও সেই টাকা পরিশোধ করা হয়নি। টাকা চাইলে তারা বলেন, বিদেশে চামড়া বিক্রি নেই, তাই দিতে পারছি না।তিনি আরও বলেন, আমরা যদি চামড়া না কিনি, তাহলে এর দরপতন ঘটবে এবং বিক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

আঁখি

×