ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৯ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিভিষিকাময় ৪৮ ঘণ্টা পার করে রাঙামাটির জনজীবনে স্বস্তি, তবে থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত

ইকবাল হোসেন, রাঙামাটি

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ৪ জুন ২০২৫; আপডেট: ২৩:৪১, ৪ জুন ২০২৫

বিভিষিকাময় ৪৮ ঘণ্টা পার করে রাঙামাটির জনজীবনে স্বস্তি, তবে থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত

ছ‌বি: জনকণ্ঠ

বিভিষিকাময় ৪৮ ঘণ্টা পার করার পর অবশেষে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে রাঙামাটির জনজীবনে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ পর্যায়ক্রমে নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পর সেটি গুরুত্ব হারানোয় প্রবল বর্ষণের আশঙ্কা কমে গেছে। ফলে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে প্রশাসন ও রাঙামাটির মানুষ। তবে এর আগে ৪৮ ঘণ্টা যেন ছিল এক বিভীষিকাময় সময়।

বৃহস্পতিবার প্রবল বর্ষণ শুরু হওয়ার পর থেকে টানা বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোটখাটো পাহাড় ধসের খবর আসতে থাকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে জেলার সকল উপজেলার মানুষ। তবে পুরো সময়টিতে জেলা প্রশাসনের সার্বক্ষণিক নজরদারি ও কুইক রেসপন্স টিমের তৎপরতায় বড় ধরনের কোনো ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গেছে জেলাবাসী।

এ নিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন জেলা প্রশাসক হাবিবুল্লাহ মারুফ। বৃষ্টির শুরু থেকেই তিনি দিনরাত এক করে সার্বক্ষণিকভাবে কুইক রেসপন্স টিমের সাথে যুক্ত থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার নির্দেশনায় মাঠে সক্রিয় ছিলেন চারজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ডিডি এলজি, সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।

কুইক রেসপন্স টিমের সাথে যুক্ত হয় রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট, সেনাসদস্য, আনসার, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, তরুণদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, রাঙামাটি পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন সামাজিক নেতৃবৃন্দ। মাঠে নেমে খোঁজখবর নেন বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও।

মঙ্গলবার বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপটি তৈরি হয়, যা পরে ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে রূপ নেয় এবং বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় তা নিম্নচাপে পরিণত হয়। পরে সেটি গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। বর্তমানে এটি গুরুত্বহীন। ফলে টানা বর্ষণের আশঙ্কা অনেকটাই কেটে গেছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে সতর্কতামূলক মাইকিং ছিল চোখে পড়ার মতো।

নিম্নচাপের প্রভাবে সৃষ্ট কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে বড় কোনো ঘটনা না ঘটলেও জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় ধস, জলাবদ্ধতা, রাস্তা, ফসলি জমি ও বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগাম সতর্কতা এবং তদারকির কারণে প্রাণহানি হয়নি। কোথাও ধসের সাথে সাথেই প্রশাসন, পৌরসভা ও রেসপন্স টিম দ্রুততার সাথে তা পরিষ্কার করেছে।

প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে, বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে ৮ হাজারের অধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ২ হাজারের অধিক।

সদর উপজেলায় ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫০টি পরিবারের ২২৫ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়। তাদের রান্না করা খাবার ও শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

কাউখালী উপজেলায় ১৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়। এর মধ্যে ৪টিতে ৬১টি পরিবারের ২১০ জন আশ্রয় নেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ৫৫০ জন এবং ঘরবাড়ির সংখ্যা ৩২টি।

বাঘাইছড়ি উপজেলায় ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৪০টি পরিবার আশ্রয় নেয় এবং তাদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। নানিয়ারচর উপজেলায় অতিবৃষ্টির কারণে ফসলি ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিলে ৮ জন আনসার সদস্য কৃষকদের ধান তুলতে সহায়তা করেন।

বরকল উপজেলায়ও কৃষকদের সহায়তায় মাঠে নামেন আনসার সদস্যরা, কারণ হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় ধানের জমি ডুবে যায় এবং দরিদ্র কৃষকেরা শ্রমিক সংকটে পড়েন।

লংগদু উপজেলার দজরপাড়া এলাকায় ৬৩টি পরিবারের ২৭৮ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়। তাদের মাঝে চাল ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো মাটি সরিয়ে সচল করা হয়।

জেলা সদর ছাড়াও কাউখালী, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু ও রাজস্থলীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের খবর পাওয়া গেছে। কাউখালী-ঘিলাছড়ি সংযোগ সড়ক ধসে পড়ে রোববার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

লংগদুতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। সেখানে একটি নির্মাণাধীন সড়কের বিভিন্ন অংশ ধসে পড়েছে এবং স্রোতে ইট, বালু ও কংক্রিট ভেসে গেছে। ফলে সড়ক চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।

বিলাইছড়ি উপজেলার কেংড়াছড়ি ইউনিয়নের তিনটি বাড়ি ধসে গেছে। সাধন চাকমা, বিশ্বজিৎ চাকমা, জীবন চাকমা, মিন্টু চাকমা ও সান্তনা চাকমার বাড়ির পাশেও ধস হয়েছে।

কাপ্তাই উপজেলার নতুনবাজার সংলগ্ন কেপিএম টিলা কার্গো নীচে পাহাড় ধসে মো. দানা মিয়া ও তার ছেলে মনির হোসেনের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বড়ইছড়ি-ঘাগড়া সড়কের মুরালী পাড়ায়ও ধস হয়েছে।

কাপ্তাই উপজেলার ইউএনও মো. রুহুল আমিন জানান, ধসে পড়া সড়কে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে এবং ধসের মাটি পানি দিয়ে সরানো হবে।

জুরাছড়ি উপজেলার যক্ষা বাজার এলাকায় সড়ক ধসে পড়ায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মগাছড়ি এলাকায় গাছ পড়ে যোগাযোগ সাময়িক বন্ধ ছিল।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের বর্ষণে মানিকছড়ি শালবাগান অংশে মহাসড়কের ১০০ মিটার ধসে পড়ে রাঙামাটির যোগাযোগ ৯ দিন বিচ্ছিন্ন ছিল।

এম.কে.

×