ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নবায়নযোগ্য জ্বালানি: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

মোঃ আবদুল্লাহ আল নাঈম,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, নোবিপ্রবি 

প্রকাশিত: ১০:১২, ৩১ মে ২০২৫; আপডেট: ১০:১৭, ৩১ মে ২০২৫

নবায়নযোগ্য জ্বালানি: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ফসিল ফুয়েলের উপর নির্ভরতা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, এবং ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা আমাদের সামনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে। বাংলাদেশ দ্রুত বাড়তে থাকা জ্বালানি চাহিদা,দীর্ঘদিন ধরে আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর ভর করে এগিয়ে চলেছে। এমন বাস্তবতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি হয়ে উঠছে এক অনিবার্য বিকল্প।

দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ৩০,৭৩৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে অন-গ্রিড (জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত) উৎপাদন সক্ষমতা ২৭,৫১৫ মেগাওয়াট এবং অফ-গ্রিড (যেমন:সৌর হোম সিস্টেম, ক্যাপটিভ পাওয়ার) ৩,২২৩ মেগাওয়াট।

বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট ১,৫৬২.০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ ১,২৬৮.০৮ মেগাওয়াট,জলবিদ্যুৎ ২৩০ মেগাওয়াট,বায়ু বিদ্যুৎ ৬২.৯ মেগাওয়াট,
বায়োগ্যাস ও বায়োমাস ১.০৯ মেগাওয়াট।
এই উৎপাদন দেশের মোট ইনস্টলড ক্যাপাসিটির মাত্র ৫ শতাংশেরও কম, যা বৈশ্বিক গড় (৩০ শতাংশের বেশি) থেকে অনেক পিছিয়ে।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবায়নের পথটা জটিল। একদিকে প্রকল্প অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা, অন্যদিকে জমির স্বল্পতা এই দুই মিলিয়ে অনেক বিনিয়োগ আটকে আছে।

২০২৩ সালের খসড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসবে। ২০৪১ সালের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে, ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে গড়ে প্রতি বছর ১০০ মেগাওয়াটের কম বিদ্যুৎ সংযুক্ত হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর অন্তত ৭০০–৮০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা যুক্ত করতে হবে, যা বিদ্যমান হারের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।

সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন বিস্তীর্ণ জমি, যা বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও কৃষিনির্ভর দেশে সহজলভ্য নয়। আবার উপযুক্ত জায়গা চিহ্নিত হলেও সেখানে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সংযোগ নেই। অনেক সময় প্রকল্প অনুমোদন পেতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়, যা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমিয়ে দেয়।
এ ছাড়া বিদ্যমান নীতিমালায় অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে। নির্দিষ্ট Feed in Tariff (সরকার নির্ধারিত বিদ্যুৎ ক্রয়মূল্য) না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না।

এর মধ্যে আশার কথা হলো,ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ১.৩ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই অর্থায়ন আসবে Team Europe Initiative এবং Global Gateway কর্মসূচির আওতায়। তবে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা, স্বচ্ছ প্রকল্প কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরিবেশগত অনুমোদন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও জার্মানির কেএফডব্লিও (Kfw) এর মতো উন্নয়ন সহযোগীরাও দেশের নবায়নযোগ্য খাতে সহায়তার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ সব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি আজ আর কেবল পরিবেশবান্ধব বিকল্প নয়, বরং তা একটি অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অপরিহার্যতা। বাংলাদেশ যেমনই জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতা, আমদানি নির্ভরতা ও মূল্যস্ফীতির চাপে সংকুচিত হচ্ছে, তেমনি বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎনির্ভর ভবিষ্যতের দিকে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, নীতিগত স্থিতি ও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ থাকলে এই সংকট বাংলাদেশের জন্য হতে পারে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার।


নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনার জানালা এখনো খোলা। সময়মতো সিদ্ধান্ত না নিলে যা হতে পারত ‘সম্ভাবনার শক্তি’, তা রয়ে যাবে নীতিমালার পাতায়, পরিসংখ্যানের চার্টে। আজ প্রয়োজন সাহসী রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ও বাস্তবমুখী পরিকল্পনার।তবেই গড়ে উঠবে এক টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং জ্বালানি-নির্ভর বাংলাদেশ।

আঁখি

×