ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩০ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সমতলের চা চাষ

উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে

তাহমিন হক ববী 

প্রকাশিত: ০০:০৬, ২৯ মে ২০২৫

উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে

শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্রায়তন চা উৎপাদনকারীর পুরস্কারপ্রাপ্ত পঞ্চগড়ের এবিএম আখতারুজ্জামানের চা বাগান

চা বিশ্বব্যাপী লাখো মানুষের সবচেয়ে প্রিয় পানীয়। ন্যাশনাল টুডের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিসেকেন্ডে মানুষ ২৫ হাজার কাপ চা পান করেন। অর্থাৎ প্রতিদিন দুই বিলিয়ন কাপের বেশি চা পান করা হয়। কৃষকের চা উৎপাদন থেকে শুরু করে চায়ের টেবিলে তা পৌঁছানো পর্যন্ত একটি বিশাল প্রক্রিয়া। ভালো পাতা, ভালো চা, ভালো দাম। জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র চা শিল্পের অবদান কোনোভাবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সমতলের ক্ষুদ্র চা চাষ উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে দ্বিগুণের বেশি চা রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
দেশের সর্ব উত্তরের পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুর জেলার উল্টোপাশেই রয়েছে দার্জিলিং। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে বিশ্বমানের চা উৎপন্ন হচ্ছে। বলতে গেলে তারকাঁটার বেড়ার ওপারে আর এপারে বাংলাদেশের মাটি, আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক অবস্থা একদম পাশাপাশি। ওই আলোকে দেশের উত্তরাঞ্চলকে হট¯পট ধরেই সমতলের চা চাষ ভূমিকা রাখছে। বলতে গেলে ক্ষুদ্র চা চাষিরাও মানসম্মত চা তৈরি করতে পারেন, তা প্রমাণিত হচ্ছে। সম্প্রতি চা দিবসে সরকারিভাবে পুরস্কার পেয়েছে ক্ষুদ্র চা শিল্পে জড়িত বেশ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। সমতলের চা চাষের পেছন থেকে বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে- পতিত জমি এখন পতিত নয়। চারদিকে চা বাগানের সবুজ গালিচা। 
১৯৯৯ সালের দিকে উত্তরাঞ্চলের চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ওই সমীক্ষায় পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার ৪০ হাজার একর জমিতে চা চাষ করা সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে চা শিল্পের শুরু হয় ১৮৫ বছর আগে। বর্তমানে দেশে ১৭০টি চা বাগান আছে। এর বেশিরভাগই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট অঞ্চলে। উত্তরাঞ্চলের সমতলের চা চাষ একটু ভিন্ন প্রকৃতির। ব্রিটিশ আমল থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে সরকারি খাস জমি লিজ নিয়ে চা চাষ করা হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে পতিত জমি ও ধান, গমের পাশাপাশি কৃষক তার চা চাষ উপযোগী জমিতে চা চাষ শুরু করেন এবং চা বোর্ডের অনুমোদিত ফ্যাক্টরিতে তা বিক্রি করছেন। বাংলাদেশ চা বোর্ড ২০০১ সালে উত্তরাঞ্চলে কার্যালয় স্থাপন করে।

এরপর তিনটি প্রকল্পের আওতায় চা বোর্ড থেকে চা চাষিদের প্রণোদনা ও ঋণ সহায়তা দিয়েছে। সমতলের চা চাষের শুরুর গল্পটা ছিল মাত্র পাঁচ ক্ষুদ্র চা চাষি দিয়ে। ২০২৩ সালে চা চাষির সংখ্যা ৮ হাজার  ৩৭১ এ দাঁড়ায়। ১৫ থেকে ২০ একর জমি নিয়ে চা চাষ শুরু হয়। ২০২৩ সাল শেষে তা ১২ হাজার ১৩২ একর জমিতে সম্প্রসারিত হয়। ২০২৩ সালের চালু থাকা ২৫টি কারখানা থেকে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়, যা মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ১৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে নিলামে চা বিক্রি হচ্ছিল না। সে সময় উত্তরাঞ্চলে প্রতিকেজি চা ৬০ / ৮০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। কারখানা মালিকরা চা চাষিদের ঠিকমতো দাম দিতে পারেননি। ফলে চা চাষিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ চা বোর্ড বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। চায়ের দাম বেঁধে দেওয়া হয়।
 এ বিষয়ে দেখা যায়,যখন চা উৎপাদনে সমতলের কৃষকরা চিন্তায় পড়ে যায় তখন এগিয়ে আসে  সলিডারিডাড। এর ফলে কৃষক, ক্রেতা, ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়। সলিডারিডাড পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চা নিয়ে কাজ করেছে। সেই তালিকায়  বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে ক্ষুদ্র চা-এর উন্নয়নও রয়েছে। এক সময় উত্তরাঞ্চলকে মঙ্গা বা অভাবী এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেখানে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি ক্ষুদ্র চা চাষ এ অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে। একসময়ের অতিদরিদ্র ৫ জেলা এখন বাংলাদেশের মানচিত্রে উন্নয়নশীল জেলা হিসাবে স্থান করে নিয়েছে।
২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত রপ্তানি ছিল বছরে এক কোটি কেজির বেশি। সেটা কমতে কমতে ২০১৩ সালে মাত্র ৫ লাখ ৪০ হাজার কেজিতে নামে। তবে ২০২৪ সালে তার আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি চা রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে রেকর্ড ১০ কোটি ২৯ লাখ ৮১ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল। দেশে এত চা আগে কখনোই উৎপাদন করা হয়নি। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে নয় কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ, আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন কমে প্রায় ৯৯ লাখ কেজি। তবে স্বস্তির খবর, একই সময়ে (২০২৩ থেকে ২০২৪) চায়ের রপ্তানি দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে চায়ের রপ্তানি হয়েছিল দশ লাখ ৪ হাজার কেজি, যা পরের বছর ২৪ লাখ ৫০ হাজার কেজি হয়। গত বছর ১৯টি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে ওসব চা। রপ্তানির তালিকায় যুক্ত হয়েছে কয়েকটি নতুন দেশ।

এদিকে চা বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০১ সালে এক কোটি ২৯ লাখ কেজি চা রপ্তানি হয়েছিল, যার মূল্য ছিল ৮৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর পরের বছর গত দুই যুগের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ চা রপ্তানি হয়। অর্থাৎ, ২০০২ সালে এক কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছিল, যার মূল্য ছিল ৯৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১০ সাল থেকে রপ্তানির বাজার হারাতে থাকলেও ২০১৩ সালে এসে একেবারেই তলানিতে নামে। ২০১৩ সালে মাত্র ৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা রপ্তানি করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। এর পর থেকে খুব বেশি বাড়েনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মান ও দামে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকার কারণে রপ্তানি বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে আশার কথা, ২০২৩ সালে ১৩টি দেশে চা রপ্তানি হলেও ২০২৪ সালে চা রপ্তানি হয়েছে বিশ্বের ১৯টি দেশে। যে কারণে রপ্তানিও বেড়েছে।

সবশেষ ২০২৪ সালে রপ্তানি হয়েছে ২৪ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা, টাকার অঙ্কে যার মূল্য ৪৫ কোটি ৯৫ লাখ। যদিও এটা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। কারণ আগের বছর রপ্তানি হয়েছিল ১০ লাখ চার হাজার কেজি চা। চা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চায়ের যে কদর ছিল সেটা আবার একটু একটু করে বাড়ছে।
দেশের প্রধান চা উৎপাদন মৌসুম জুন থেকে নভেম্বর। বর্তমানে দেশে বার্ষিক চাহিদা সাড়ে আট কোটি কেজি থেকে নয় কোটি কেজির মধ্যে। বাকি চা রপ্তানি হচ্ছে। এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের মানুষের মধ্যে চা পানের আগ্রহ বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলের  মানুষও এখন প্রতিদিন চা পান করে। এই চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে এখন প্রায় চার হাজার কোটি টাকার চায়ের বাজার গড়ে উঠেছে। উৎপাদনের বেশিরভাগই এখন স্থানীয় বাজারে ভোক্তার চাহিদা পূরণে ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) উদ্ভাবিত ২৮টি চায়ের জাতের মধ্যে মাত্র পাঁচটি জাত দেশে ব্যাপকহারে চাষ হচ্ছে। উচ্চফলন, গুণমান ও জলবায়ু-সহিষ্ণুতার কারণে এসবের চাষ বেশি। এই জাতগুলোকে ‘চা ক্লোন’ বলা হয়। এগুলো বীজের পরিবর্তে গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত গাছ। এই পদ্ধতিতে উচ্চফলন ও রোগপ্রতিরোধের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চারা তৈরি করা হয়।
বিটিআরআইর পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন জানান বিটি-ওয়ান (১৯৬৬ সালে তৈরি), বিটি-২ (১৯৭৫), বিটি-৪ (১৯৮১), বিটিএস-১ (১৯৮৫) ও টিভি-১ (১৯৪৯) নামের এই পাঁচ ক্লোন থেকে প্রতি হেক্টরে গড়ে তিন থেকে চার হাজার কেজি চা পাওয়া যায়। খরা সহনশীলতা ও দার্জিলিংয়ের চায়ের মতো স্বাদ ও সুবাসের কারণে বিটি-২ সবচেয়ে জনপ্রিয়  জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিটি-২ ভালোমানের ব্ল্যাক টি ও গ্রিন টি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের চা শিল্পের আকার বিবেচনায় এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত ক্লোনের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। আরও নতুন ক্লোন আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চলছে।’ তিনি আরও জানান, সাধারণত মানুষ পুরোনো ও প্রমাণিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন। চায়ের ক্ষেত্রেও তা সত্য। বাগান-মালিকরা পুরোনো ও পরীক্ষিত ক্লোনের চা গাছ রোপণ করতে পছন্দ করেন।

তার মতে, বাগান-মালিকরা সাধারণত তিন থেকে পাঁচটি বাছাই করা ক্লোনের চা গাছ রোপণ করেন, যাতে তারা বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। একটি ভালোমানের ক্লোন তৈরি করতে প্রায় ১৩ বছর সময় লাগে। এর বাণিজ্যিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৫০ বছর। তবে বাগান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর ফলে বহুমুখীকরণের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাগান-মালিকরা বলছেন, চায়ের উৎপাদন ও বিক্রি বাড়াতে জলবায়ু ও খরাসহিষ্ণু ও ভালোমানের দিকে মনোযোগ দিয়ে বিটিআরআইয়ের উচিত আরও ক্লোন তৈরি করা। জনপ্রিয় বিটি-১, বিটি-২ ও টিভি-১ জাতের চা চাষ করা হয়। ‘এই ক্লোনগুলো জলবায়ুসহিষ্ণু, স্বাদ ও সুগন্ধের কারণে অগ্রাধিকার পায়। বাজারে এগুলোর পছন্দসই বেশি।

তবে দেশে উচ্চ ফলনশীল জাতের সংকট আছে। আরও খরাসহনশীল ক্লোনের প্রয়োজন। ‘কারণ দেশে বছরের পাঁচ থেকে ছয় মাস খুব কম বৃষ্টি হয়। সব জায়গায় সেচ দেওয়া সম্ভব না। এতে  উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজার ধরতে চায়ের গুণগত মানস¤পন্ন ভিন্ন ভিন্ন জাত উদ্ভাবন জরুরি। এটা করা গেলে আমাদের চা শিল্পে ভ্যালু অ্যাডিশন হবে। সামগ্রিক প্রক্রিয়াটির জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বরাদ্দের প্রয়োজন।

×