ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩০ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সমুদ্রগামী জেলেদের জীবননির্ভর নদী খাপড়াভাঙ্গা ভরাট-দখল ও দূষণে ঝুঁকির মুখে

মেজবাহউদ্দিন মাননু, নিজস্ব সংবাদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ২৮ মে ২০২৫; আপডেট: ২৩:৫১, ২৮ মে ২০২৫

সমুদ্রগামী জেলেদের জীবননির্ভর নদী খাপড়াভাঙ্গা ভরাট-দখল ও দূষণে ঝুঁকির মুখে

ভরাট, দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে খাপড়াভাঙ্গা নদী। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় শিববাড়িয়া মৌজায় এ নদীর অবস্থান থাকায় জেলেরা শিববাড়িয়া নদী বলে আসছেন। মৎস্য বন্দর মহিপুর ও আলীপুরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া এ নদীটি এখন ভাটার সময় মাছ ধরার ট্রলার চলাচল উপযোগী থাকে না। গভীর সমুদ্রগামী জেলেসহ অগভীর সমুদ্র এলাকায় মাছ ধরার হাজার হাজার ট্রলার দূর্যোগের সময় এ নদীতে আশ্রয় নেয়। এ নদীকে একারণে পোতাশ্রয় বলা হয়। এছাড়া ফি বছর সাগরের আহরিত ইলিশসহ ৪০-৪২ হাজার মেট্রিকটন সামুদ্রিক মাছ এখানকার ট্রলারের জেলেরা নদীতীরের বন্দরে লোড-আনলোড করেন।  নদীটি কলাপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, তালতলীসহ চিটাগং কক্সবাজারের অন্তত ৫০ হাজার জেলের জীবন-জীবিকার অবলম্বন। কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবে পলির আস্তরণে এ নদীটার তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। সংকুচিত হয়ে গেছে দুই পাড়। এই সুযোগে দুই তীর দখল করে ইটভাটা, করাতকল করা হয়েছে। করা হয়েছে বাড়িঘর, পুকুর, মাছের ঘের থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। ফেলা হচ্ছে পলিথিন, প্লাস্টিক, কর্কসিটসহ সব ধরনের বর্জ্য। টনকে টন বর্জ্যে একাকার নদীতীরসহ ভেতরে পর্যন্ত ভাসছে। আন্ধার মানিক নদী থেকে উজানের পানির স্রোত এখন আর প্রবলবেগে বহমান থাকে না। নদীটি অস্তিত্ত্ব এখন সংকটে পড়েছে।এই নদীটার দুই দিক থেকেই জেলেদের সাগরে যাওয়া আসার সুযোগ রয়েছে। দূর্যোগের সময় জেলেদের নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার এই নদীটা ১৫ বছর আগে তৎকালীন সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে পুনর্খননের উদ্যোগ নেয়। এ জন্য কয়েকদফা সমীক্ষা চালানো হয়েছে। কিন্তু এই উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেনি। এখন ভাটিতে নৌযান চলাচল বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ফলে জেলেরা দূর্যোগকালীণ আশ্রয়স্থল হারাতে বসেছে।

জানা গেছে, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে খাপড়াভাঙ্গা এই নদীটি পুনর্খননের জন্য পানিউন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী অফিস থেকে একটি ডিপিপি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। চ্যানেলটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পুনরায় নাব্যতা সৃষ্টি, মহিপুর-আলীপুর মৎস বন্দরের জেলেদের লোডিং-আনলোডিং এর সুবিধা, চ্যানেলটির দুই পাড়ে বেড়িবাঁধের ভেতরের সংযোগ স্লুইসখালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখা এবং কৃষিকাজের স্বার্থে সরকারিভাবে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। চ্যানেলটি পুনর্খননের প্রকল্প তৈরি করে প্রায় ৬৭ কোটি ব্যয়-বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, দীর্ঘ এই নদীর (চ্যানেলটির) দুই দিক দিয়ে জেলেরা সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া আসা করছে। কিন্তু নদীর আন্ধার মানিক এবং আশাখালী প্রবেশদ্বারসহ ৯০ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। জোয়ারের সময় জেলেরা কিছুটা নিরাপদে চলাচল করতে পারছে। ভাটায় চলাচল বন্ধের উপক্রম হয়েছে। উত্তাল সাগরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হলে দ্রুত নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার জন্য এই নদীটি ছাড়া আর কোন পথ নেই। কিন্তু দুই দিকের সাগর মোহনা থেকে দীর্ঘ পথ পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় ট্রলারসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের আশঙ্কা হয়েছে। নদীর দুই পাড়ে লতাচাপলী, মহিপুর, ডালবুগঞ্জ, ধুলাসার ইউনিয়ন অবস্থিত। রয়েছে বেড়িবাঁধ। ওই সময় নদীটি খননের বাস্তবতা নিরূপনের লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ টিম সরেজমিন পরিদর্শন করেন। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া গেলে এই খনন কাজ শুরুর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। উল্টো এই নদীর সঙ্গে সংযুক্ত আরও তিনটি শাখা নদীতে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গাববাড়িয়ার নদীতে ক্লোজার করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে এমনটি হয়েছে।পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয়ের তৎকালীন সময়ে কর্মরত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী উজ্জল কুমার সেন জানিয়েছিলেন, নদীটির তলদেশ তিন মিটার থেকে কোথাও কোথাও আট মিটার পর্যন্ত গভীর খনন করতে হবে। এছাড়া প্রস্থ ৩০ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ৬০ মিটার পর্যন্ত খনন করতে হবে। খনন করলে জেলেদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে বলে জানান, উপকূলীয় মাঝি সমিতির সভাপতি মোঃ নুরু মিয়া। এছাড়া বরফ, মাছসহ বিভিন্ন মালামাল উঠানামা করাতে জেলেদের দুর্ভোগ লাঘব হবে বলে জানান, মৎস আড়ত মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ গাজী ফজলুর রহমান। কিন্তু নদীটি খনন না করায় ভরাটের পাশাপাশি দেদার তীর এলাকা দখল করে মাটি ভরাট করে নেওয়া হয়েছে। লতাচাপলী এলাকার মাইটভাঙ্গা স্পটে দুইটি ইটভাঁটার মালিকরা নদীটির দীর্ঘ এলাকা ভরাট করে দখলে নিয়েছে। বিভিন্ন স্পটে নদী তীর দখল করে করাতকল করা হয়েছে। এছাড়া পলিথিন, ছেড়া জাল, কর্কসিট বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ফ্রি-স্টাইলে। প্রতিনিয়ত পলিতে ভরাটের পাশাপাশি দূষণে এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দুই পাড়ে অসংখ্য মাছের ঘের করা হয়েছে। পাড় থেকে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল নিধন করা হয়েছে। নয়নাভিরাম এই নদীটি এখন  জেলেরা স্বাচ্ছন্দে ব্যবহার করতে পারছে না। নাব্যতা সঙ্কটের পাশাপাশি ভরাট-দখলে দীর্ঘ নদীটি মৃতপ্রায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. শাহআলম ভুইয়া জানান, তিনি বিষয়টি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখবেন। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানালেন।পরিবেশ কর্মীরা মনে করছেন, খাপড়াভাঙ্গা নদীকে রক্ষা করতে হলে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নইলে এই নদীটি বিলীন হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। আর এর প্রভাব পড়বে মৎস্যখাতের ওপর। অন্তত জেলেসহ ৫০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকায় সংকট সৃষ্টি হবে। দেশের অন্যতম ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের মোকাম বন্ধ হয়ে যাবে। সামুদ্রিক মৎস্য খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে এই নদীটি রক্ষায় এখনই উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানালেন পরিবেশ কর্মী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আমরা কলাপাড়াবাসীর সভাপতি নাজমুস সাকিব।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বরিশালের সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, যেখানে বর্তমান সরকার সারা দেশে খাল-নদী দখল-দূষণমুক্ত করছেন। সেখানে খাপড়াভাঙ্গা নদী দখল-দূষণ হওয়া উদ্বেগজনক বিষয়। বিষয়টি কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি পরিবেশ ও নদী আইন বিরোধী।

বনবিভাগ মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, খাপড়াভাঙ্গা নদী তীরের করাতকল মালিকদের ইতপূর্বে নোটিশ করেছেন। আবার তিনি দেখবেন বলে জানালেন।

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, এই নদীটি রক্ষা করা না হলে গোটা উপকূলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সক্রিয় ৫০ হাজার জেলে পরিবার তাদের পেশা হারাবে। ল্যান্ডিং স্টেশন না থাকলে সমুদ্রগামী মৎস্য আহরণ করতে পারবে না। দেশের মৎস্য অর্থনীতিতে ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব পড়বে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, জেলেদের দাবির প্রেক্ষিতে সাগর থেকে আসা ট্রলার নদীতে প্রবেশের জন্য তিনি এক বছর আগে এ নদীর প্রবেশদ্বার আন্ধারমানিক মোহনায় জেগে ওঠা ডুবোচর খনন করে দিয়েছেন। বর্তমান সমস্যার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন। আর পুনর্খননের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাবেন।

 

রাজু

×