
তখন আমি ফরিদপুর জিলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের নিয়মকানুন তখনো এতটা কড়া ছিল না, তাই ক্লাস শেষে আমাদের বেশিরভাগ সময় কাটত স্কুলের আঙিনায় একটা বিশাল কড়ই গাছের নিচে আড্ডা দিয়ে।
আমাদের পাশেই ছিল আরেকটি স্কুল, এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঝে কেবল একটি দেয়াল ছিল। সেই দেয়াল টপকে অন্য স্কুলটিতে ঢুকে পড়া তেমন কঠিন কিছু ছিল না। তবে ওই স্কুলে একজন শিক্ষক ছিলেন, যাকে সবাই ভীষণ ভয় পেত—এমনকি আমাদের স্কুলের ছেলেরাও তাঁর ভয়ে সেই এলাকায় পা বাড়াতে সাহস করত না। তাঁর সম্পর্কে পাশের স্কুলের ছাত্ররাই বেশি ভালো বলতে পারবে।
ওই স্কুলের ভেতরে ছিল একটি বড় আমগাছ, যাতে থোকায় থোকায় আম ঝুলত। গাছটি ছিল আমাদের স্কুলের সীমানা দেয়ালের একদম গা ঘেঁষে। তাই আমরা প্রায়ই ঢিল ছুড়ে আম পাড়তাম এবং কষ্ট করে দেয়াল টপকে সেই ভয়ংকর শিক্ষকের এলাকায় গিয়ে আম তুলে আনতাম।
‘যেইখানে বাঘের ভয়, সেইখানেই সন্ধ্যা হয়’—এই প্রবাদটা একদিন অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে গিয়েছিল। সেই শিক্ষক লুকিয়ে ছিলেন দেয়ালের পাশেই। আমার তিন বন্ধু যেই না দেয়াল টপকে অন্য স্কুলের সীমানায় নামল, অমনি তিনি তাঁদের ধরে ফেললেন। আমি তখনো দেয়াল টপকাতে পারিনি।
ততক্ষণে আমার বন্ধুদের আর্তচিৎকার শুরু হয়ে গেছে, “ওরে বাবা! স্যার, আমাদের ছেড়ে দিন! আর কখনো এমন করব না!” তিনি তাঁদের বেত দিয়ে পেটাচ্ছিলেন। নিরবে বন্ধুদের এমন পরিণতি দেখা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন।
একদিন টিফিনের সময় আমরা কয়েকজন বন্ধু সেই কড়ই গাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ চোখ গেল পাশের স্কুলের দ্বিতীয় তলার একটি ক্লাসরুমের পাশে ঝুলে থাকা বড় একটি মৌচাকে। সেই রুমে প্রায় প্রতিদিনই সেই শিক্ষক ক্লাস নেন।
আমাদের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল—"আজ সেই ভয়ংকর শিক্ষককে শিক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে। মৌমাছির কামড় থেকে তাঁকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না!"
তিনি তখন সদ্য ক্লাসরুমে ঢুকেছেন। আমরা আর দেরি না করে কাছে গিয়ে সেই মৌচাকে ঢিল ছুঁড়লাম।
তারপর কী যে হলো! স্কুলের মৌমাছিগুলো শিক্ষককে আক্রমণ না করে আমাদের দিকেই তেড়ে এলো!
আমরা আর দেরি না করে স্কুলের পেছনের বড় মাঠের দিকে দৌড় দিলাম। এর মধ্যেই আমাদের তিনজনকে কয়েকটা মৌমাছি হুল ফুটিয়ে দিয়েছে। আমাকে ঠিক কতগুলো হুল ফুটিয়েছে, তা হিসাব করা কঠিন। আর কোনো উপায় না পেয়ে আমরা সবাই মাঠের মাঝখানে শুয়ে পড়লাম।
টিফিনের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মৌমাছির ভয়ে আমরা মাঠ থেকে নড়তে পারছিলাম না। আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রায় পনেরো–বিশ মিনিট পর আমরা ক্লাসে ঢুকলাম।
মৌমাছির কামড়ে শরীর ব্যথা করছিল, তার উপর শ্রদ্ধেয় স্যার দেরিতে ক্লাসে ঢোকার জন্য আমাদের বিশ বার কান ধরে উঠবস করালেন।
আর তখনই আমরা সবাই বুঝতে পারলাম—খারাপ কাজের ফল কখনো ভালো হয় না। ভুল কাজ করলে তার শাস্তি একদিন না একদিন ফিরে আসে নিজের উপরেই। এরপর থেকে আমরা আর কোনোদিন ভয়ে মৌচাকে ঢিল ছুঁড়িনি।
সজিব