
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের প্রথম নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ ১৯১৩ সালে তৈরি হয়েছিল মারাঠি ভাষার শিরোনাম কার্ড দিয়ে। কিন্তু গত কয়েক দশকে মারাঠি সিনেমা পথ হারিয়ে ফেলেছিল, বলিউডের হিন্দি ছবির চাপে পড়ে। তবে, কি সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে?
সমালোচকদের প্রশংসিত মারাঠি ভাষার ড্রামা ‘স্থল’ (A Match) শুরু হয় এক ব্যতিক্রমধর্মী দৃশ্য দিয়ে—বিয়ের জন্য কনে নয়, বরকে দেখা হচ্ছে। কিন্তু খুব শিগগিরই দর্শক বুঝে যায়, এটা সাভিতার স্বপ্ন। বাস্তবে সে ভারতীয় নারীদের মতোই—যাদের জীবনে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার রীতি-বাঁধা বিয়ের পেছনে লড়াই করে যেতে হয়।
‘স্থল’ ভারতের ব্যবস্থাপনায় বাধ্যতামূলক বিয়ের অন্ধকার দিক তুলে ধরেছে, যা প্রায়শই রোমান্টিক নাচ-গানের মোড়কে ছবিতে দেখানো হয়। এটি এমন এক ঢেউয়ের অংশ—যেখানে একাধিক মারাঠি সিনেমা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হচ্ছে। ‘সাবার বন্ডা’, দুটি পুরুষের গ্রামীণ ভালোবাসার গল্প, ইতিহাস গড়েছে প্রথম মারাঠি সিনেমা হিসেবে সানডান্স চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়ে। এটি গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কারও পেয়েছে।
মিনাক্ষী শেড্ডে, টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দক্ষিণ এশীয় সিনেমার জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম উপদেষ্টা, একে "সাহসী ও সূক্ষ্ম গ্রামীণ সমকামী প্রেমের গল্প" হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এর কাহিনির বর্ণনাকে "ঐতিহাসিক" বলে মন্তব্য করেছেন।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রারম্ভিক পথিকৃৎ মারাঠি সিনেমা দীর্ঘদিন বলিউডের আধিপত্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু গত এক দশকে তারা ধীরে ধীরে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে। ২০১৬ সালে নাগরাজ মঞ্জুলের ‘সাইরাত’ বার্লিনে প্রদর্শিত হয়। পরে চৈতন্য তামহানের ‘দ্য ডিসাইপল’ ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে স্থান পায়—যা মীরা নায়ারের ‘মনসুন ওয়েডিং’ এর পর প্রথম ভারতীয় সিনেমা হিসেবে সেখানে প্রদর্শিত হয়। এই ছবির নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন অস্কারজয়ী আলফন্সো কুয়ারন। এরপর কমপক্ষে এক ডজন স্বাধীন ও পরীক্ষাধর্মী মারাঠি সিনেমা আন্তর্জাতিক উৎসবে জায়গা করে নেয়।
হার্ষদ নলাওয়াড়ের ‘ফলোয়ার’, রটারড্যাম উৎসব নির্বাচিত একটি সিনেমা, ভারতের তরুণদের চরমপন্থায় দীক্ষিত হওয়ার গল্প বলে। সুভদ্রা মহাজনের ‘সেকেন্ড চান্স’, একটি সাদা-কালো আত্মজৈবনিক গল্প, বাসানে প্রদর্শিত হয় এবং জুন মাসে ভারতের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে যাচ্ছে।
মারাঠি সাহিত্যের শক্ত ভিত্তি ও পরীক্ষামূলক নাটকের প্রভাবেই এই সিনেমাগুলো আলাদা বলে মত দিয়েছেন শেড্ডে। তাঁর মতে, অনেক নির্মাতা স্বশিক্ষিত, ক্ষমতাকেন্দ্রের বাইরে, এবং তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা সিনেমায় অনন্য রূপ এনেছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘সাবার বন্ডা’র নির্মাতা রোহন কানাওয়াড়ে মুম্বাইয়ের বস্তিতে বড় হয়েছেন, কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন। তবে অন্যান্য আঞ্চলিক চলচ্চিত্রের মতো নিয়মিত ভিত্তিতে মারাঠি সিনেমা তৈরি হয় না। এর কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাব।
‘স্থল’-এর প্রযোজক শেফালি ভূষণ জানান, তারা নিজেরাই টাকা দিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। বড় স্টুডিওগুলো স্পষ্টভাবে ব্যবসাসফল মনে না হলে মারাঠি সিনেমা নেয় না। মহারাষ্ট্র সরকারও কেরালার মতো সহায়তা করে না। বলিউড-কেন্দ্রিক মুম্বাই ও পুনে ঘিরে মারাঠি সিনেমা বলিউডের দমবন্ধ করা চাপ অনুভব করে, যা অন্য আঞ্চলিক সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রে হয় না। ভাষা সচেতনতার দিক থেকেও কেরালা অনেক এগিয়ে, যেখানে ধানচাষিরাও আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে।
সমালোচক অশোক রানে বলছেন, নির্মাতারাও অনেক সময় বৈশ্বিক দর্শকদের জন্য উপযোগী বিষয়বস্তু বেছে নেন না। সেইসঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার অভাব ও উদ্যমের ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরে ভালো সিনেমার কবরস্থানে পরিণত করেছিল ভারতকে। তবে সানডান্স ও কান উৎসবের স্বীকৃতি এই চিত্র বদলাতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন শেড্ডে।
ভূষণ জানান, মহারাষ্ট্র সরকারের সহায়তায় কান উৎসবে সিনেমা প্রদর্শন করার সুযোগ পেয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এটি বিভিন্ন দেশে সিনেমা বিক্রি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় নতুন সিনেমা নির্মাণের পথ খুলে দিচ্ছে।
শহীদ