
ছবি : জনকণ্ঠ
“মসজিদের বারান্দায় যখন পানি ছুঁইছে, তখনই বুঝেছিলাম আর বাঁচব না। কিন্তু ভাঙনের আগেই যদি কেউ একটু সাহায্য করত, হয়তো কিছুটা রক্ষা পেত!” — কথাগুলো শেষ করতে পারলেন না ষাটোর্ধ্ব মো. হাশেম মিয়া। চোখের জল মুছতেও যেন ভুলে গেছেন। এমনই চরম অসহায়তার চিত্র এখন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের ঝালরচর বাজার এলাকায়।
গত কয়েক দিনের টানা ভারী বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হু হু করে বাড়ছে জিনজিরাম নদীর পানি। তার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যা, আর দক্ষিণ অঞ্চলে দেখা দিয়েছে তীব্র নদীভাঙন। নদীর গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে এলাকার শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদ, কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঝালরচর সেতু এবং শতাধিক ঘরবাড়ি।
নদীতীর ঘেঁষে দাঁড়ানো সেই প্রাচীন মসজিদটি স্থানীয়দের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এক সময়ে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত আজানের ধ্বনি শোনা যেত, সেখানে এখন কেবল ভাঙনের গর্জন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. আব্দুল মজিদ বলেন, “এই মসজিদে আমার দাদা আজান দিতেন। আমি ছোটবেলা থেকেই এখানে নামাজ পড়ি। এখন চোখের সামনে দেখি, পানি কীভাবে ধীরে ধীরে মসজিদটা গিলে ফেলছে। বুকটা যেন খালি হয়ে যাচ্ছে।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, জিনজিরাম নদীর মিলনস্থলে ব্রহ্মপুত্র ও দশানী নদীর সঙ্গে পানির তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ ব্রহ্মপুত্র নদের খননের কাজ করছে বিডব্লিউটিএ (BWTA)। তাদের সুবিধার্থে ব্রহ্মপুত্র নদের মুখে কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে জিনজিরাম নদীর সমস্ত পানি এখন দশানী নদীর দিকেই গড়িয়ে যাচ্ছে, যা সৃষ্টি করেছে তীব্র স্রোতের ভাঙন।
ব্যাপক নদীভাঙনের কারণে ঝুঁকির মুখে পড়েছে ঝালরচর বাজার সংলগ্ন ব্রিজটিও। এই সেতুটি শুধু ইউনিয়নের নয়, পুরো উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. কামরুল মাস্টার জানান, “এই ব্রিজটা ধ্বংস হয়ে গেলে আমরা সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। যাতায়াত, ব্যবসা, চিকিৎসা—সব বন্ধ হয়ে যাবে।”
এ পর্যন্ত নদীগর্ভে চলে গেছে একশর বেশি ঘরবাড়ি, দোকান, ফসলি জমি ও গাছপালা। গৃহহীন মানুষগুলো এখন খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন। এক মা, কোলে শিশুকে নিয়ে জলের দিকে চেয়ে বললেন, “ঘর গেছে, কাপড় গেছে, চালডাল সব গেছে। এখন কী খামু, কোথায় থাকুম?”
অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, যেকোনো মুহূর্তে মসজিদ, ব্রিজ ও আশপাশের এলাকা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেতে পারে। এলাকাবাসী বারবার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও এখনো পর্যন্ত কোনো টেকসই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দুঃখের বিষয়, এই অঞ্চলের নদীভাঙন নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রতিবারই কিছু বালির ব্যাগ ফেলা বা একটি সভা করেই কর্তৃপক্ষ কর্তব্য শেষ করে ফেলে। অথচ ক্ষতিগ্রস্তরা বছরের পর বছর হারিয়ে যায় নদীর স্রোতে—হারিয়ে যায় তাদের কষ্টে গড়া সংসার, ইতিহাস আর ভালোবাসা।
নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। নয়তো কাল আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। থাকবে শুধু কান্না, শোক আর নদীর বুকে চাপা পড়ে থাকা এক গ্রামের না বলা গল্প।
এ বিষয়ে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান জানান, “আমি খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি এবং পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে এসেছি। কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি এবং দ্রুত একটি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
সা/ই