ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

বিলুপ্তির পথে সিনেমা হল: রাজবাড়ীতে সাংস্কৃতিক চর্চার অপমৃত্যু

শফিকুল ইসলাম শামীম, নিজস্ব সংবাদদাতা রাজবাড়ী

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ১২ মে ২০২৫

বিলুপ্তির পথে সিনেমা হল: রাজবাড়ীতে সাংস্কৃতিক চর্চার অপমৃত্যু

এক সময় গ্রাম থেকে শহরে আসার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল সিনেমা হল। টিকিট পাওয়ার জন্য লাইন, গেটের সামনে হট্টগোল, আর হল ভর্তি দর্শকের করতালি। সব মিলিয়ে সিনেমা দেখা ছিল এক ধরনের উৎসব। কিন্তু সেই রঙিন দিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। রাজবাড়ী জেলার পাঁচটি উপজেলায় যেখানে এক সময় ২০টি সিনেমা হল সচল ছিল, সেখানে এখন মাত্র ৩টি হল কোনো মতে টিকে আছে।

সিনেমা হল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজবাড়ী সদর উপজেলায় ৬টি, বালিয়াকান্দিতে ৬টি, পাংশায় ৪টি, গোয়ালন্দ ৩টি ও কালুখালীতে ১টি সহ মোট ২০টি সিনেমা হল চালু ছিল। অথচ এর মধ্যে ১৭টি হল ইতোমধ্যে ভেঙে সেখানে গড়ে উঠেছে বিপণি বিতান, আবাসিক ভবন ও অন্যান্য বাণিজ্যিক স্থাপনা।

একাধিক সিনেমা প্রেমীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৯০ দশক এর শেষ পর্যন্ত এসব হলে ছিল উপচে পড়া ভিড়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছবি দেখতে যাওয়াটা ছিল একধরনের পারিবারিক বিনোদন। শুক্রবার নতুন ছবি মুক্তি পাওয়ার আনন্দও ছিল ঈদ উৎসবের মত। টিকিট সংগ্রহ করার মধ্যে ছিল রীতিমতো যুদ্ধ। আবার এক টিকিটে দুই ছবি দেখার এক সুযোগ আসতো। স্কুলের টিফিন এর টাকা সংগ্রহ করেও অনেকে সিনেমা দেখতো।

কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে দর্শক কমতে শুরু করে। টিভি চ্যানেলের আধিপত্য, ইন্টারনেট, ভিসিবি, ডিস্ক এবং পরে স্মার্টফোন ও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের আগমনে সিনেমা হলগুলো দিনে দিনে দর্শকশূন্য হয়ে পড়ে। সাধারণ দর্শকদের ধারণা সিনেমা হল গুলো দর্শক শূন্য হওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হলো বর্তমান যুগের নায়ক-নায়িকা ও বিভিন্ন কলা কৌশরীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় উন্মুক্ত। তারা নিজেদের খুব সস্তা পণ্য হিসেবে পরিচিত করছেন। তাদের পারিবারিক সমস্যা গুলোও ফেসবুকে লাইভ করছেন। যে কারণে সাধারণ দর্শক তাদের বর্জন করছেন। 

সরেজমিনে বর্তমানে রাজবাড়ী জেলায় সচল থাকা ৩টি সিনেমা হলও নানা সংকটে জর্জরিত। পুরোনো অবকাঠামো, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব এবং মানসম্পন্ন ছবি না পাওয়ায় দর্শক ফিরছে না। অথচ এই হলগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজবাড়ীর সংস্কৃতি, স্মৃতি এবং বহু মানুষের জীবিকার প্রশ্ন।  

প্রায় ৫০ বছর সিনেমা হলে কর্মরত নারায়ন (নারান দা) বলেন, সিনেমা হলে হাফ প্যান পরে বাদাম বিক্রি শুরু করেছি। সেই সেথে আজও পর্যন্ত সিনেমা হল কর্মরত আছি।

তিনি বলেন, এখন কেউ সিনেমা দেখে না। বিভিন্ন উৎসবে সচল রাখলেও খরচের টাকা উঠানো সম্ভব হয় না।

তিনি আরও বলেন, জেলায় আমাদের মালিকের একাধিক সিনেমা হল ছিল। এখন হল গুলো বিলুপ্তি হয়ে গেছে। একটি সিনেমা হল রয়েছে। তবে বছরের সর্বোচ্চ ৩টি সিনেমা চালানো হয়। কিন্ত মালিক কখনও আসে না।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি উদ্যোগে পুরোনো হলগুলোকে আধুনিকায়ন করে সংস্কৃতি চর্চার জায়গা হিসেবে পুনঃস্থাপন করা গেলে শুধু বিনোদনই নয়, তরুণ প্রজন্মের মাঝে সিনেমা সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।

সিনেমা হলে প্রায় ২০ বছর কর্মরত থাকা আব্দুল খালেক প্রামানিক বলেন, সিনেমা হলে প্রায় ২০ বছর চাকরী করেছি। একটি সময় সিনেমা হলে দেখেছি সাধারণ মানুষের চাহিদা। শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা পূর্বে সিনেমা হলে সামনে মনে হত জনসমাবেশ চলছে। কিন্ত এখন চোখের নজরে পড়ে না।

তিনি বলেন, এখন শুনি অনেক সুপার স্টার, কিন্ত তারা হকারী করে তাদের ছবি দেখার আমন্ত্রন জানান। তবে আগের কোন নায়ক-নায়িকার চেহারা দেখা সহজ ছিল না। 

শেখ জহরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া লেখাকালীন নিয়মিত ছবি দেখতাম। কি ছরি দেখেছি নাম ও নায়ক-নায়িকা এবং অতিপরিচিত শিল্পীদের নাম লেখে রাখতাম। যা আজও পর্যন্ত আমার সংগ্রহ রয়েছে। কোন ছবির কে নায়ক-নায়িকা, কোন সালে মুক্তি পায় আমি এখনও বলে দিতে পারি। 

রাজবাড়ী একাধিক সিনেমা হলের মালিক মো. তোফাজ্জেল মিয়া বলেন, একটি সময় সিনেমা হলে ভালো ব্যবসা ছিল। বিনিয়োগ করলে লোকসান হওয়ার কোন সম্ভবনা ছিল না। এখন সিনেমা হল মানে লোকসান। সুতরাং কেউ লোকসান মাথায় নিয়ে ব্যবসা করবে না। তিনি বলেন, সিনেমা হল বাঁচাতে হলে অবশ্যই দর্শকদের চাহিদা মাথায় নিয়ে তৈরি করতে হবে। না হলে সকল চেষ্টা ব্যর্থ হবে।

সজিব

×