ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

বিষ ছাড়া বিষ্ময়: গ্রামের মাঠে নিরাপদ সবজির বিপ্লব

জামাল বাদশা, লালমনিরহাট

প্রকাশিত: ১৪:১৭, ১২ মে ২০২৫

বিষ ছাড়া বিষ্ময়: গ্রামের মাঠে নিরাপদ সবজির বিপ্লব

এক সময় আমাদের গ্রামবাংলায় শাকসবজি মানে ছিল রাসায়নিকের বিষবাষ্প। আজ ঠিক সেখানে, লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামে উঁকি দিচ্ছে এক নতুন কৃষিচিত্র, যেখানে বিষমুক্ত সবজির চাষ হচ্ছে, আর সেইসব সবজিতে ভরসা রাখছে গ্রামবাসী। এখানে শুধু খাদ্য নয়, এখানে নতুন এক কৃষি-চিন্তা, যা কৃষককে অনুপ্রাণিত করছে, ভোক্তাদের আস্থা তৈরি করছে। জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চলবলা ইউনিয়নের একটি ক্ষুদ্র প্রদর্শনী প্লটে শুরু হয়েছে এই পরিবর্তনের সূচনা। এক একর জমিতে কৃষক মাসুদ আহমেদ চাষ করছেন করলা ও শসাসহ নানা জাতের সবজি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে। রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক ছাড়া, নির্ভেজাল উপায়ে উৎপাদিত এসব সবজি এখন তার গ্রামেই নতুন আশা জাগাচ্ছে।

মাসুদ বলেন, শুরুর দিকে সত্যিই সন্দেহ ছিল। বিষ ছাড়াও কি ফলন হবেকিনা।  কিন্তু এখন নিজের চোখেই দেখছি। ফলন ভালো, রোগবালাই কম, আর মাটির গন্ধও অপরিবর্তিত। বাজারেও ভালো দাম পাবো বলে আশা করছি। ক্ষেতে পোকামাকড় দমনে ফেরোমন ফাঁদ, আগাছা দমনে মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। এছাড়া প্লটে প্রবেশের পূর্বে হাত ধৌত ও হাত, পা এবং মুখে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামুলক করা হয়েছে।

উত্তম কৃষি চর্চার এই প্রদর্শনী প্লট শুধু তার জন্য নয়, প্রতিবেশী কৃষকদের জন্যও একটি শিক্ষাক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রদর্শনীতে কাজ করা কৃষক ও শ্রমিকরাও আগ্রহী হচ্ছেন বিষ ও কীটনাশক মুক্ত ফসল উৎপাদনে। চলবলার বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রায়ই আমি নিয়মিত মাসুদের জমিতে গিয়ে কাজ করেছি। দেখছি,শিখছি। আমার বাড়ীর পাশের কিছু জমিতে এই পদ্ধতিতে চাষ করবো ভাবতেছি। একই এলাকার বাসিন্দা শ্রমিক
হাফিজার আলী বলপন, এই প্রদর্শনীতে কাজ করছি। প্রায়ই অনেক কৃষক আসছে। পরিদর্শন করছে এবং এই পদ্ধতিতে কিভাবে চাষ ও ফসলের ফলন হয় তা নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। সুন্দর পরিবেশে কাজ করতে নিজেরও ভালো লাগে বলে মন্তব্য তার।

রাসায়নিক সার ও কীটনাশক সার মুক্ত চাষাবাদ নিয়ে কাজ করা 'গ্যাপ বাংলাদেশ'-এর ‘উত্তম কৃষি চর্চা’ প্রকল্প। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় রংপুর বিভাগের ৩৫টি উপজেলায় এই প্রকল্প চলছে। এর আওতায় ৪৫ জন কৃষক প্রদর্শনী প্লটে কাজ করছেন, এবং তাঁদের দেওয়া হচ্ছে উন্নত মানের বীজ, জৈব সার, ফেরোমন ফাঁদ, মালচিং সামগ্রীসহ সকল প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ।

গ্যাপ বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের সিনিয়র মনিটরিং কর্মকর্তা অশোক কুমার রায় বলেন, আমরা শুধু করলা, শসা নয়, আরও ৮ ধরনের সবজি এবং ৫ ধরনের ফল নিয়ে কাজ করছি। যেমন লাউ, ঢেঁড়স, মুলা, বরবটি, পালং শাক, টমেটো, বেগুন, লাল শাক। এছাড়া ফলের মধ্যে পেঁপে, পেয়ারা, কলা, আম এবং লেবু রয়েছে। ২০২৮ সালের মধ্যে সারা দেশে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে আমাদের।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. সাইখুল আরেফিন জানান, “উত্তম কৃষি চর্চা প্রকল্প শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, এটি দীর্ঘমেয়াদে কৃষকের জন্য লাভজনকও। আমরা চাই, প্রতিটি কৃষক এই পদ্ধতিটি জানুক, শিখুক এবং এটি কাজে লাগাক।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে, কৃষক, প্রশাসন ও সমাজের সচেতন মানুষের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। আমরা কৃষকদের পাশে আছি—প্রশিক্ষণ, উপকরণ ও উৎসাহ দিয়ে।

মুমু

×