
ছবিঃ সংগৃহীত
বায়োস্কোপ—যার শাব্দিক অর্থ চলচ্চিত্র বা ছায়াচিত্র। সেলুলয়েড ফিল্ম আবিষ্কারের পরবর্তী সময়টিই ছিল বায়োস্কোপের স্বর্ণযুগ। ইতিহাস সূত্র বলে, বিদেশি উদ্যোক্তা স্টিফেন্স ১৮৯৬ সালে একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে কলকাতায় আসেন এবং বায়োস্কোপ প্রদর্শন করেন। এরপর তাঁর উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণায় মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন ১৮৯৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করলে এটি হয়ে ওঠে অনন্য এক বিনোদন মাধ্যম। মূলত গ্রামবাংলায় বায়োস্কোপ সমাদৃত হওয়ায় একে ‘গ্রামবাংলার সিনেমা হল’ও বলা হয়।
তবে শহরাঞ্চলেও এর প্রভাব কম ছিল না। আধুনিক ঢাকার প্রতিষ্ঠালগ্নে নওয়াব বাড়িতে নিয়মিত বায়োস্কোপের আসর বসত বলে জানা যায়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল একশ্রেণির মানুষের জীবন ও জীবিকা। তারা বংশ পরম্পরায় সেটি লালন করত। মাথায় ছোট লাল রঙের কাঠের অথবা টিনের বাক্স নিয়ে রংবেরঙের অদ্ভুত পোশাক পরে গ্রামের পথেঘাটে হেঁটে বেড়াত বায়োস্কোপ দেখানোর উদ্দেশ্যে। তাদের হাতে বাজতে থাকা খঞ্জনি বা করতালের শব্দ আর কণ্ঠে ছন্দোময় বাক্য জনতাকে আকৃষ্ট করত। আর পেছনে পেছনে ঘুরত একদল ছেলেমেয়ে।
ছোট্ট সেই চারকোণা বাক্সের তিনদিকে চারটি, ছয়টি অথবা আটটি ছোট ছোট গোল জানালা থাকত যা আতশি কাচে ঢাকা থাকত। দর্শক এই কাচের ওপর চোখ রেখেই দেখত বায়োস্কোপের ছবি। ভিতরে প্রদর্শিত ছবিগুলো আকারে বড় দেখাত ও নিকটবর্তী মনে হতো। বাক্সের অপরদিকটি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রদর্শক। তিনি অবিরত ছবি পালটাতে থাকতেন, সঙ্গে ‘তারপরে কী হলো/জরিনা সুন্দরী এলো/কানে তাহার দুল ছিল/কী চমত্কার দেখা গেল’ এমন সব কথার ছন্দ ও করতালের ঝংকারে স্থির ছবিগুলো প্রাণবন্ত করে তুলতেন দর্শকের কাছে। দর্শক ছবি ও কথার মধুর দৃশ্যে হাসত আবার কষ্টদায়ক দৃশ্য দেখে চোখের পানিও ফেলত। তাদের কাছে বাইস্কোপ ছিল জাদুর বাক্সের মতো। একসঙ্গে ছয় থেকে আট জনের বেশি দর্শক বায়োস্কোপ উপভোগ করতে না পারায় বাকিরা প্রবল উত্সাহ ও উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারের লাইনটির মতোই ভিড় জমত এখানে। আর বায়োস্কোপ দেখা শেষে পয়সা বা চাল তুলে দিত প্রদর্শকের হাতে।
গ্রামে বৈশাখী মেলা বা দুর্গা পূজার মতো উত্সবগুলো বায়োস্কোপ ছাড়া জমত না। এছাড়া হাটে-বাজারে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে নিয়মিত বায়োস্কোপের আসর বসত। বাংলার ইতিহাস, রাজা-বাদশাদের জীবনকাহিনি, ঐতিহাসিক নিদর্শন, বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী, মক্কা-মদিনা এসবই ছিল বায়োস্কোপের প্রদর্শনসূচি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ ঘটেছে প্রযুক্তির; বায়োস্কোপ ছাড়িয়ে এলো সিনেমা হল এবং ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ। আর হারিয়ে গেল বায়োস্কোপ প্রদর্শন।
ইমরান