ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

কোন সে হাসপাতাল, যেখানে সবাই ভুয়া...

প্রকাশিত: ১৩:৩৫, ৩ এপ্রিল ২০২৪

কোন সে হাসপাতাল, যেখানে সবাই ভুয়া...

ভুয়া লোকজন নিয়েই বছরের পর বছর ধরে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল হাসপাতালটি

লাইসেন্সের মেয়াদ নেই হাসপাতালের। চিকিৎসক নেই, নেই দক্ষ কোনো নার্স। যে ক’জন আছে তারা সবাই ভুয়া। এসব ভুয়া লোকজন নিয়েই বছরের পর বছর ধরে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল হাসপাতালটি।

গাজীপুরের মাওনা এলাকার ‘লাইফ কেয়ার হাসপাতাল’। মাওনা-ফুলবাড়িয়া সড়কের পাশে একটি ভবন ভাড়া নিয়ে মানুষকে সেবা দেওয়ার নামে গড়ে তোলা হয় হাসপাতালটি। স্থানীয়রা বলছেন, এটি লাইফ কেয়ার নয়, ‘ডেথ কেয়ার হাসপাতাল’ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে। 

সর্বশেষ গত রবিবার অদক্ষ নার্সের মাধ্যমে ইয়াসমিন আক্তার নামে এক অন্তঃসত্ত্বাকে অস্ত্রোপচার করে বাচ্চা প্রসব করানোর সময় তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় আসে হাসপাতালটি। 

গত জানুয়ারি মাসে পারভীন আক্তার নামের এক নারীর শরীরে ভুল গ্রুপের রক্ত প্রবেশ করানোর অভিযোগ উঠেছিল এ হাসপাতালের বিরুদ্ধে। ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর এ হাসপাতালকে বিভিন্ন অপরাধে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন র‍্যাব-১ পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই বছর ১৩ মার্চ মোছা. শিমু নামের এক প্রসূতিকে ভুল চিকিৎসা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। 

নার্সের মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্রোপচারে ইয়াসমিন আক্তারের মৃত্যুর পর গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে লাইফ কেয়ার হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন গাজীপুর জেলা সিভিল সার্জন মাহমুদা আক্তার। পরিদর্শন শেষে সিভিল সার্জন প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় লাইফ কেয়ার হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা হাসপাতালের কার্যক্রম চালাচ্ছে। বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। 


এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন মাহমুদা আক্তার জানান, এ হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ নেই। দক্ষ লোকজন নেই। যারা আছে তারা সবাই ভুয়া। এত ভুয়ার মধ্যেও তারা কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার দুঃসাহস পেল? কোথায় পেল এত দুঃসাহস?

পরিদর্শন শেষে সিভিল সার্জন মাহমুদা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, ‘লাইফ কেয়ার হাসপাতালের একজন সিস্টারের সঙ্গে কথা বলেছি, সে আসলে সিস্টার নয়, সে কোথাও থেকে পড়াশোনা করেনি। যিনি ব্লাড সংগ্রহ করেন, তার কোনো ট্রেনিং নেই। রোগীর ফাইলে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস্ পাওয়া যায়নি, প্রতিটি রোগীরই একই কেস, কোনো ওটি নোট লেখা নেই। শুধু কনসার্ন পেপারে আছে, যাতে কোনো ডাক্তারের স্বাক্ষর নেই। যারা লিখছে তারা সেখানে কী লিখছে, সেটাও তারা বলতে পারছে না। মানে এটা অদক্ষতা না কী, আমি কী বলব! এটা তো অদক্ষতার মধ্যেও পড়ে না। এই সম্পর্কিত লোকই না তারা।’

সিভিল সার্জন বলেন, ‘আমি হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছি। এ জন্য আমি এসেই ভর্তি রোগী কয়জন আছে তার খোঁজখবর নিয়েছি। শনি এবং রবিবার অপারেশন হওয়া তিনজন রোগী ভর্তি আছেন। আজকে রাতে না হলেও আগামীকালের মধ্যে তাদের ছুটি দিতে পারবে।’

রবিবার ইয়াসমিন আক্তার নামে এক অন্তঃসত্ত্বাকে নার্সের মাধ্যমে অস্ত্রোপচারের অভিযোগ ওঠে। পরে অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়। ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্রোপচারে প্রসূতির মৃত্যুর খবর পেয়ে নিহতের স্বজনরা ছাড়াও হাসপাতালে জড়ো হন শত শত মানুষ। এক পর্যায়ে তারা ভাঙচুর চালান। নিহত ইয়াসমিন গাজীপুর সদর উপজেলার বানিয়ারচালা গ্রামের ব্যবসায়ী মো. আসাদুল্লাহর স্ত্রী। এই দম্পত্তির ইকরা মণি নামে ১০ বছর বয়সী মেয়ে আছে। ইয়াসমিনের বাবার বাড়ি শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া এলাকায়। 

ইয়াসমিনের মা রাজিয়া আক্তার বলেন, তাঁকে না জানিয়ে তাঁর মেয়েকে হাসপাতালের নার্সের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ভুল অস্ত্রোপচারে তাঁর মেয়ের মৃত্যু হওয়ার পর তারা অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়। এরই ফাঁকে পালিয়ে যায় হাসপাতালের সবাই। 

হাসপাতালের মালিক আজহারুল ইসলাম পারভেজ জানান, গাইনি চিকিৎসক মৌসুমী আক্তার লিজা অস্ত্রোপচার করেছিলেন। কোনো নার্স অস্ত্রোপচার করেননি। হাসপাতাল থেকে কেউ পালিয়েও যায়নি। 

হাসপাতালের ম্যানেজার মো. হাসান বলেন, আমাদের হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে। বন্ধ করা হয়নি।

এবি 

×