
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর মাঠে ময়দানে জোট নির্বাচনী হাওয়া
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর মাঠে ময়দানে জোট নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সর্বত্র চলছে নির্বাচন ও সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা। যার যার অবস্থান থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানা কৌশলে নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের সামনে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করছেন এবং দোয়া প্রার্থনা করছেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন। কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৩৩ নম্বর আসন সিলেট-৫। এই দুই উপজেলায় মোট ভোটার ৩ লাখ ২৪ হাজার ৫০৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৯১ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৬১ হাজার ১২১ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ১৫৮টি।
বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য হচ্ছেন আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট শিল্পপতি হাফিজ আহমদ মজুমদার। তিনি একাধারে একজন শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী এবং রাজনীতিবিদ। তিনি সিলেটের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।
হাফিজ মজুমদার তার চাচা সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুর রহমান মজুমদারের পরিবর্তে ১৯৯১ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করে এই আসনে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন হাফিজ আহমদ মজুমদার। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটের কারণে আওয়ামী লীগ আসনটি ছেড়ে দেয়। সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে নৌকার প্রতীক নিয়ে হাফিজ আহমদ মজুমদার বিপুল ভোটের ব্যবধানে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির একাধিক প্রার্থীর নাম আলোচনায় রয়েছে। সিলেট-৫ আসনটি দখলে রাখতে আওয়ামী লীগ নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নিচ্ছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি ও বিএনপি এই আসনে ভাগ বসাতে চায়। জাতীয় পার্টি ও বিএনপি দু’দলই এই আসনে প্রতিনিধিত্ব করেছে।
এই আসনে পরপর তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য হাফিজ মজুমদার বয়সজনিত কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাচ্ছেন না এমন গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময় এলাকায় নেতৃত্বে থাকলেও জনগণের সঙ্গে তার কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বলে কিছু নেতাকর্মীদের অভিযোগ। তাদের বক্তব্য- বর্তমান সংসদ সদস্য একাধিকবার এই আসন থেকে নির্বাচিত হলেও বর্তমানে নির্বাচনী এলাকায় খুব একটা সময় দিতে পারেন না। আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে তার খুব একটা তৎপরতা দেখা না গেলেও, নেতাকর্মীদের ধারণা তিনি আবারও সিলেট-৫ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হবেন।
অন্যদিকে, আসন্ন নির্বাচনে এই আসনে প্রার্থী হিসেবে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিনকে নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা স্বপ্ন দেখছেন। মাসুক উদ্দিন এলাকায় জনপ্রিয় ব্যক্তি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে আছেন দীর্ঘকাল যাবত। উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। সাদা-সিদে জীবন যাপনে অভ্যস্ত মাসুক উদ্দিন ২০১৪ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন। সে সময় জোটের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী তাকে সরে যেতে বললে তিনি প্রত্যাহার করে নেন। মাসুক উদ্দিন এলাকায় কাজ করছেন। তিনি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।
এ ব্যাপারে মাসুক উদ্দিন বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী দল। নেত্রী চাইলে নির্বাচন করব। এর আগে কখনো নেত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে যাইনি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস নেত্রী এবার আমাকে মনোনয়ন দেবেন। তিনি বলেন, সিলেট-৫ আসনে আরও অনেক উন্নয়নমূলক কাজ দরকার। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতিতে ‘গ্রাম হবে শহর’ সেই স্বপ্নপূরণে কাজ করে এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চাই। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় সংসদে জনগণের পক্ষে তৃণমূলের কথা বলতে চাই। বর্তমান সরকার দেশের উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। আমি সেই উন্নয়নকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে গ্রামকে শহরে রূপান্তর করতে কাজ করে যেতে চাই।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা প্রতীকে এমএলএ পদে জয়ী হয়েছিলেন আব্দুল লতিফ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে এই আসনে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময়ে নৌকার আব্দুল লতিফ এমপি পদে জয়লাভ করেন। এরপর ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পুলিশের সাবেক আইজিপি মো. আব্দুল হক (এম এ হক) বাঘ প্রতীকে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তিনি সরকারের ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এই আসনে জাতীয় পার্টি থেকে ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদার লাঙল প্রতীকে জয়লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদুর রহমান ধানের শীষ প্রতীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে সিলেট-৫ আসন থেকে মিনার মার্কায় খেলাফত মজলিসের মাওলানা আলহাজ ওবায়দুল হক উজিরপুরী জয়লাভ করেন। এ সময় তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের হাফিজ আহমদ মজুমদার।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন হাফিজ আহমদ মজুমদার। এরপর ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাফিজ আহমদ মজুমদারকে পরাজিত করে জামায়াতের মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী জয়লাভ করেন। এরপর ২০০৮ সালে জামায়াতের মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করে ফের আওয়ামী লীগের হাফিজ আহমদ মজুমদার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিন জয়লাভ করেন। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ জাতীয় পার্টির সেলিমের সঙ্গে সমন্বয় করেন। এতে সেলিম উদ্দিন জয়লাভ করেন। এরপর ২০১৮ সালে পুনরায় হাফিজ আহমেদ মজুমদার জয়লাভ করেন।
এ ব্যাপারে সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন জকিগঞ্জ, কানাইঘাটবাসীর সেবা করে আসছি। আমি সংসদ সদস্য থাকাকালীন অবহেলিত এ দুই উপজেলায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতা কাজে লাগাতে চাই। আমার দল আর জনগণ চাইলে আমি নির্বাচন করব।
এ আসনে তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য হাফিজ মজুমদার ছাড়াও এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ। সীমান্তিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ড. আহমদ আল কবির, সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সিলেট বিভাগীয় আইনজীবী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমদ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ পলাশ। সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরীও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, দলীয় কর্মসূচি নিয়ে তৃণমূলে কাজ করা বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা চালিয়ে যাচ্ছেন ভোটের রাজনীতি। বিএনপির একাধিক প্রার্থী দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। দলের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন- কানাইঘাট উপজেলা বিএনপির সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন, কানাইঘাট পৌর বিএনপির সভাপতি চাকসু মামুন, ইকবাল আহমেদ, বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা চৌধুরী।
এখানে বিএনপির একটি অংশ হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা চৌধুরীকে প্রার্থী দেওয়ার পক্ষে কাজ করছেন। হারিছ চৌধুরীর জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে আসনটি নিজেদের দখলে নিতে চায় বিএনপি। হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরীর সঙ্গে হারিছ চৌধুরীর পরিবারের দ্বন্দ্ব থাকার কারণে দুটি পক্ষ দু’দিকে কাজ করছে।
এখানে জাতীয় পার্টি থেকে সাবেক এমপি সেলিম উদ্দিন ছাড়াও সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাংগঠনিক সম্পাদক শাব্বীর আহমদ, দলটির কেন্দ্রীয় নেতা সাইফ উদ্দিন আহমেদ খালেদ ও পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মতিন চৌধুরীর নাম শোনা যাচ্ছে।