ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পেশা ছাড়ছেন মৃৎশিল্পীরা

নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর 

প্রকাশিত: ১৭:২৪, ১ এপ্রিল ২০২৩

প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পেশা ছাড়ছেন মৃৎশিল্পীরা

মৃৎশিল্পী

লোকসংস্কৃতি ও লোকজশিল্পের একটি অন্যতম প্রধান শাখা হলো মৃৎশিল্প। কৃষিনির্ভর বাঙালি সমাজ থেকে বাংলায় মৃৎশিল্পের উৎপত্তি হয়েছে। মৃৎশিল্পের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছে সমাজভুক্ত মানুষের প্রয়োজনে। প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা পূরণের জন্যই মৃৎশিল্প বিকাশ লাভ করেছে। মৃৎশিল্প মাদারীপুর জেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। 

এ শিল্পের সাথে জড়িত জেলার সহস্রাধিক মানুষ। এরা কুম্ভকার বা কুমোর বা কুমার নামে পরিচিত। কুমার বা পাল সম্প্রদায়ের লোক এদের অন্তর্গত। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পাল বংশের লোক এ পেশায় নিয়োজিত। কাঁদামাটি দিয়ে কুমোররা বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতির এবং সাইজের হাড়ি-পাতিল-বাসন-কোসনসহ গৃহস্থলির কাজের উপযোগী নানা পণ্য তৈরি করে থাকেন। হাত এবং চাকার সাহায্যে কাঁদা মাটি দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরির পর কাঁচা থাকতে তাতে কাঠি দিয়ে পাতা, ফুল, পাখি ও রেখাদির নক্শা করা হয়। কখনও আবার দ্রব্যাদির পোড়াবার পর এতে নানা রঙের সমাবেশে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় নকশা করা হয়। 

খেলার পুতুল ও ঘর সাজানোর সৌখিন দ্রব্যও কুমোরেরা তৈরি করেন। পাল বা কুমোরেরা হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণ করেন। বাঁশ, খড়কুটা, মাটি, কাপড় ও রং দ্বারা নির্মিত তাদের এ মূর্তিগুলো এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। কুমার শ্রেণীর সাধারণ মেয়েরা মৃৎশিল্পের নানা দ্রব্য তৈরিতে তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে সাহায্য করেন। 

এতে রয়েছে তাদের সুনিপুণ দক্ষতা। এ সব পণ্যের প্রধান উপকরণ মাটি। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেলামাইন, স্টিল, সিলভার, কাঁচের তৈরি বাহারী ও মনকাড়া সব পণ্য বাজারে আসায় এ সব লোকজশিল্পের কদর দিন দিন কমে এসেছে। তাই ওই সব আধুনিক হাড়ি-পাতিল-বাসন-কোসনসহ গৃহস্থলি পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত অনেক পরিবার ধীরে ধীরে এ পেশা ছেড়ে যাচ্ছেন জীবন-জীবিকার টানে। এক সময় এই জনপদ মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। 

বর্তমানে কারখানা থেকে উৎপাদিত দৈনন্দিন গৃহস্থালী সরঞ্জাম বা তৈজসপত্রের সর্বাপেক্ষা ব্যবহার হওয়ায় মাটির তৈরি তৈজসপত্রের আবেদন আশংকাজনকহারে কমে গেছে। তবে এখনও গ্রামের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজের জন্য মাটির বিভিন্ন জিনিসপত্র ব্যবহার করে থাকেন। যেমন : হাড়ি, কলসি, মটকা, বিভিন্ন ধরণের ব্যাংক, ফুলদানী, সান্কি, বদনা, দইয়ের ভাঁড়, ঘটি, মালসা, পাতিল, ছাইদানী ইত্যাদি। এ থেকেই মাদারীপুরের লোকায়ত মৃৎশিল্পের একটি বিমূর্ত পরিচয় ফুটে ওঠে। ঐতিহ্য পরম্পরায় পাল সম্প্রদায়ের মানুষ এ শিল্পের কারিগর।

মৃৎশিল্পীরা শুধুমাত্র হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করেন না তারা বিভিন্ন রকমের খেলনা সামগ্রী, ফুলদানী, পটারি তৈরি করে থাকেন। এসব জিনিসপত্র বিভিন্ন ধরণের ছাঁচে তৈরি করা হয়। সাধারণত বিভিন্ন মেলা উপলক্ষে এসব সামগ্রী বেশি পরিমানে তৈরি করা হয়। এছড়াও মৃৎশিল্পীরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন রকমের পশুপাখি তৈরি করে থাকেন। মাটির তৈরি ব্যাংক দেশে অনেক বেশী প্রচলিত একটি সামগ্রী। মাটির তৈরী সামগ্রীতে সাধারণত নক্শা করা হয় নরম থাকা অবস্থায়। মৃৎশিল্পের কারিগররা বংশ পরাম্পরায় মৃৎশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বৃদ্ধ, ছেলে, মেয়ে, বৌ-ঝি সকলেই মৃৎশিল্পের কাজ করে থাকেন।

মৃৎশিল্পীরা মাটির দ্রব্য উৎপাদনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন “চাক্”। কুমোর সম্প্রদায়ের রুজি-রোজগারের প্রধান উৎস হল এই “চাক্”। এই চাক্কে কেন্দ্র করে কুমোর সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। বৈশাখ মাসে এ এ অঞ্চলের কুমোররা চাকের কাজ করেন না। 

এ মাসের প্রথম দিনই চাক্ পূজা করা হয়। এই একটি মাস চাকের ওপর শিবের মূর্তি বসিয়ে রাখা হয়। পূজার জন্য তারা ডালসহ আম পাতা, সিঁদুর ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। কমোররা এই ১ মাস চাকের কাজ না করলেও মাটি সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং হাত দিয়ে তৈরিকৃত মৃৎশিল্পের কাজ করে থাকেন। তারা শীত মৌসুমেও এঁটেল মাটি সংগ্রহ করে থাকেন। 

এ কাজের সঙ্গে নারীরাই প্রধানত বেশি কাজ করে থাকেন। মৃৎশিল্পীরা রঙের ক্ষেত্রে  প্রাকৃতির রঙ ব্যবহার করেন। যেমনঃ চকের গুঁড়া, তেঁতুল বিচি, ইটের গুঁড়া ইত্যাদি। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাজারের কৃত্রিম রঙ ও ব্যবহার করা হয়। দৈনন্দিন জীবনে মানুষের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র হিসেবে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা। যেমনঃ ফুলদানী, ছবির স্ট্যান্ড, বিভিন্ন ধরণের ঘর সাজানো  ওয়ালম্যাট, মাটির গহনা, মাটির শো-পিস ইত্যাদি। মাটির তৈজসপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় কুমোরদের মধ্যে অনেকেই এখন রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ী, গার্মেন্টস শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। 

বর্তমান চাহিদার সাথে মিল রেখে যারা মাটির সৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করার ক্ষেত্রে কাঠামো অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের ছাঁচ ব্যবহার করছেন তাদের পরিবারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। অতীতকালে কুমোর সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার হার কম থাকায় প্রায় সকলেই নিরক্ষর ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেকেই শিক্ষিত হচ্ছে এর কারণে তাদের মধ্যে কেউ কেউ পেশার পরিবর্তন করলেও কিছু মানুষ আছে যারা তাদের পৈত্রিক এ পেশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে মৃৎশিল্পের কাজ করে যাচ্ছেন। পাল সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করার পাশাপাশি বাড়িতে মা বাবার সাথে এই মাটির কাজ করে থাকেন। মাটির তৈরি জিনিসপত্রগুলো বিপণনের জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে প্রেরণ করা হয়ে থাকে। 

মাদারীপুর জেলায় এক সময়ে মৃৎশিল্পের ছিল জমজমাট অবস্থা। তখন এ শিল্পের সাথে শত শত লোক জড়িত ছিল। বর্তমানে পূর্ব পুরুষের পেশা হিসেবে কুমোররা কেউ কেউ এ শিল্পকে ধরে রেখেছেন। এ পেশা তাদের আয়ের উৎস, জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। জেলার প্রতিটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মৃৎশিল্প তৈরীর ভাটা রয়েছে (চুন্ডী)। মৃৎশিল্পের উপকরণ উপযুক্ত মাটি এবং পোড়াবার নাড়া, খড় এ জেলায় এক সময় সহজলভ্য হওয়ায় এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। তাছাড়া জেলার আধিবাসীরা দরিদ্র এবং অসচ্ছল হওয়ার কারণে মৃৎশিল্পের বিভিন্ন দ্রব্যাদি বেশী ব্যবহৃত হতো। জেলায় বিখ্যাত এবং বড় ধরণের মেলাও বসতো অনেক। 

এসব মেলায়, হাটে এবং গ্রাম-গঞ্জে বিক্রি হতো অগণিত দ্রব্য সামগ্রী। নানা ধারণের দেব-দেবীর নির্মাণে এ জেলার শিল্পীদের ছিল ব্যাপক সুনাম এবং সু-খ্যাতি। দুর্গাপূজা-কালিপূজা বিশেষ করে সরস্বতি পূজা অত্যন্ত জাঁকজমক এবং আড়ম্বরপূর্ণভাবে এ জেলায় পালিত হয়। সরস্বতি পূজা উপলক্ষে মাদারীপুর শহরে শত শত মন্ডপ নির্মিত হয়। এ জেলায় শিল্পীদের চমৎকার সূক্ষ্মতায় এবং দক্ষতায় নির্মিত এসব মূর্তি দেখতে অত্যন্ত সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। মাদারীপুর জেলার কয়েকজন মৃৎশিল্পী তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং মানসম্পন্ন শিল্পকর্মের জন্য এতদাঞ্চলে বিখ্যাত। এরা হলেন-ঘটুপাল, কালিদাস পাল, পাগলা পাল, জগদীশ পাল, অতুল পাল প্রমুখ।

মাদারীপুর জেলার বিস্তৃত ভূমি নীচু হওয়ায় এবং সবসময় পানি থাকায় এ জেলায় প্রচুর আমন ধানের চাষ হত। ফলে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ধানকাটা শেষে পাওয়া যেত বিশাল খড়ের গাঁদা-স্তুপ। এত বিশাল ছিল এ নাড়া খড়ের প্রাপ্যতা যে, অনেক সময় সংগ্রহের ঝামেলায় এগুলো ক্ষেতে পুড়িয়ে ফেলা হত। বিনা পয়সায় এবং স্বল্প শ্রমে কুমারেরা গাঁদায়-গাঁদায় এ উপকরণটি সংগ্রহ করতেন। মৃৎশিল্পে ব্যবহৃত এ সহজলভ্য উপকরণটি এখন আর সহজে পাওয়া যায় না, এটি এখন দুষ্প্রাপ্যতা। ইরি ধানের আগমনে এবং কৃষির আধুনিকায়নে নাড়া খড় এখন পাওয়া যায় না বললেই চলে। শত শত ইটের ভাটায় হাজার হাজার মণ কাঠের ব্যবহারে কুমারের কপালে এখন হাত। 

তাই এ শিল্পে নিয়োজিত লোকদের আজ বড় দুর্দিন। তাছাড়া মেলার সংখ্যা কমে যাওয়ায়, গ্রামের মানুষ শহর ও বিদেশমুখী হওয়ায়, তাদের অবস্থা স্বচ্ছল হওয়ার কারণে মৃৎশিল্পের ব্যবহারও কমে গেছে বহুলাংশে। সিলভার, স্টীল, স্টেইনলেস স্টীল, প্লাষ্টিক, সিরামিক-চীনা মাটির অত্যাধুনিক দ্রব্যাদির চমকে মৃৎশিল্পের দ্রব্যাদি ম্রিয়মান এবং মৃতপ্রায়। অনেকেই এখন পূর্বপুরুষের পেশাকে বদল করে অন্য পেশা গ্রহণ করছেন। অতীতে বিভিন্ন খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, জলাভূমি ইত্যাদি স্থান থেকে এঁটেল মাটি সংগ্রহ করতেন। 

কিন্তু বর্তমানে দ্রুত নগরায়ণের ফলে এসব জলাভূমি, খাল-বিল ভরাট হওয়ার কারণে মাটি সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে অনেকাংশে। দুর্ভোগ সত্ত্বেও ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্পের ধারক-বাহক কুমোর সম্প্রদায়ের কিছু নারী-পুরুষ এখনও তাদের পৈত্রিক পেশাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন।       
           
বর্তমানে মাদারীপুরে কুমোর সম্প্রদায়ের ১৫৫ পরিবারের ৭৭৫ নারী-পুরুষ মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত থেকে কোনমতে টিকে আছেন। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ৪৩ পরিবার, রাজৈর উপজেলায় ৫৮পরিবার, শিবচরে ২৮ পরিবার এবং কালকিনিতে ২৬ পরিবার। সদর উপজেলার পূর্ব রাস্তি, কুলপদ্দী, ঘটমাঝি, মস্তফাপুর, রাজৈর উপজেলার খালিয়া, গোয়ালবাথান, সেনদিয়া, কদমবাড়ি, মজুমদারকান্দি, শিবচর উপজেলার চান্দেরচর, দ্বিতীয়াখন্ড, দত্তপাড়া, পাচ্চর, কালকিনি উপজেলার বাঁশগাড়ির খাসেরহাট, কালকিনির পালপাড়া। 

জেলার উল্লেখযোগ্য মৃৎশিল্পীরা হলেন, সদর উপজেলার রতন পাল, সন্তোষ পাল, সরণ পাল, বিষু পাল, নন্দ পাল, রাজৈর উপজেলার নারায়ণ পাল, দিলীপ কুমার পাল, আনন্দ পাল, বাচ্চু পাল, কালকিনি উপজেলার মাধব পাল, মরণ পাল, সারদা সুন্দরী পাল, অনীল পাল (১), অনীল পাল (২), সুশীল পাল, নকুল চন্দ্র পাল, সহদেব পাল এবং শিবচর উপজেলার রমেশ পাল, ভূবন পাল ও রমনী পাল। ঘটুপাল, কালিদাস পাল, পাগলা পাল, জগদীশ পাল, অতুল পাল। এরা সকলেই মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরির পাশাপাশি সব ধরণের দেবদেবীর প্রতিমা তৈরিতে দক্ষ। 

এমএস

×