ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাছ বাদে অন্য কিছু আহরণের সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের

সুনীল অর্থনীতির সুফলপ্রাপ্তি এখনো চ্যালেঞ্জ

নয়ন চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ০০:১৯, ৯ ডিসেম্বর ২০২২

সুনীল অর্থনীতির সুফলপ্রাপ্তি এখনো চ্যালেঞ্জ

গণহারে বাস রিকুইজিশনের প্রতিবাদে অক্সিজেন মোড় এলকায় শতশত যানবাহন থেমে আছে

মূল ভূখণ্ডের প্রায় সমান সমুদ্র এলাকা পেলেও বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি নিজেদের জলসীমায়। সুনীল অর্থনীতির (ব্লু ইকোনমি) উন্নয়নে তাই অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর ফলে এখনো আসেনি প্রত্যাশিত ফলাফল। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হলেও অব্যবস্থাপনা ও নানা সীমাবদ্ধতায় মাছ ছাড়া অন্য কোনো কিছুই আহরণ করার সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের।

গ্যাস, খনিজ বালি এবং পাথরসহ নানা কিছু আহরণের সুযোগ থাকলেও অপর্যাপ্ত নীতিমালা, কর্মপরিকল্পনার অভাব, দক্ষ জনশক্তির অপ্রতুলতা এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে ব্লু ইকোনমির প্রাচুর্যতা থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে দেশ।
২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে আনুমানিক ৯শ কোটি। এই বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দিতে সামুদ্রিক সম্পদের বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্য নিয়ে জাতিসংঘ ২০১৫ থেকে টেকসই উন্নয়ন হাতে নিয়েছে, যার মূল বার্তা ব্লু ইকোনমি। বাংলাদেশ সমুদ্র বিজয়ের পর সুনীল অর্থনীতি নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিল। কিন্তু জ¦ালানির মতো অনেক জরুরি উপাদান আহরণে এখনো নেই তেমন সফলতা।

মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর সুনীল অর্থনীতি নিয়ে আশায় বুক বেঁধে থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ত্রিপক্ষীয় রশি টানাটানির জের হিসেবে প্রায় ৭ বছর এ খাতে কোনো সুফল এখনো আসেনি। তবে মৎস্যখাতে ধীরে ধীরে তা কিছুটা হলেও অর্জিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ৭১০ কিলোমিটারের উপকূলীয় অঞ্চলসহ ৩ হাজার ৮৮৬ বর্গ কিলোমিটারের দুটি সামুদ্রিক মৎস্য সংরক্ষণ এলাকায় নজরদারির সক্ষমতা নেই সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের। অপরদিকে বাংলাদেশের সামুদ্রিক একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ইইজেডের সর্বশেষ প্রান্ত পর্যন্ত সমুদ্রের গভীরতা আছে ২২শ মিটার। কিন্তু বাণিজ্যিক বা যান্ত্রিক ট্রলারগুলো সমুদ্র উপকূল থেকে ১০ থেকে ৪০ মিটার গভীর পর্যন্ত মাছ শিকার করে।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, দেশে মৎস্য আহরণে নিয়োজিত বাণিজ্যিক ট্রলার রয়েছে ২৩৫টি। আর যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক ট্রলার আছে ৬৮ হাজার। তবে লাইসেন্স আছে ৬ হাজার নৌযানের। সাগরে ১০ মিটার গভীরতার পর হতে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এলাকা বিস্তৃত। ১০ মিটার গভীরতা থেকে ৪০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত যান্ত্রিক মৎস্য আহরণ এলাকা।

৪০ মিটার গভীরতার পর থেকে একান্ত অর্থনৈতিক এলাকার শেষসীমা পর্যন্ত বাণিজ্যিক ট্রলারের আহরণ এলাকা বিস্তৃত। একান্ত এলাকার বাইরে লং লাইনার, পার্সসেইনার দিয়ে আহরণ করার অনুমতি থাকলেও এ ধরনের কোনো ট্রলার না থাকায় মৎস্য আহরণে সক্ষমতা নেই বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের।
বর্তমানে বঙ্গোপসাগর থেকে সর্বাধিক আহরিত মাছের প্রজাতি হলো সার্ডিন। এরপর রয়েছে ম্যাকারেল, ইলিশ, ছুরি, পোয়া, রূপবান, লইট্টা, চিংড়ি, কাঁটা মাছ, রূপচাঁদা। বিগত পাঁচ বছর ধরে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু খনিজ, বালিসহ বিভিন্ন উপাদান আহরণে কোনো ধরনের সক্ষমতা নেই দেশের।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকা এখন বাংলাদেশের।
সঙ্গে আছে ২শ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধপূর্ণ ১৭ ব্লকের ১২টি পেয়েছে বাংলাদেশ। আর প্রতিবেশী বন্ধুদেশ ভারত থেকে পেয়েছে দাবিকৃত ১০টি ব্লক। এসব ব্লকে বিশাল মজুত রয়েছে তেল গ্যাসের, এমন ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও সিউইড ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির ঝিনুক, লবস্টার চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্র তলদেশে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতিও পেয়েছেন অনুসন্ধানকারীরা। এ ছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুতও রয়েছে। যেসব ব্লক পাওয়া গেছে সেখানে বাংলাদেশের বাপেক্স ও বিদেশি কোম্পানি অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করছে তেল গ্যাস রয়েছে কি না।

তবে সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য বিষয়  হলো সমুদ্র উপকূলে খনিজ বালি, খনিজ ধাতু উত্তোলন করে প্রচুর অর্থ আয় করা সম্ভব। এই খাতে কোনো ধরনের গবেষণা ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি বিধায় বঙ্গোপসাগরে এ সকল মূল্যবান খনিজ ধাতু এখনো চিহ্নিত হয়নি। এ ছাড়া ভারী খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে জানা গেলেও এসব উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। ফলে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশ।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের নথিসূত্রে জানা গেছে, সুনীল অর্থনীতিতে গভীর সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বাংলাদেশ। এর ব্যাপ্তি আরও বাড়ানো সম্ভব। এ ছাড়া সমুদ্রে মাছের চাষ (মেরিকালচার), অপ্রচলিত সামুদ্রিক সম্পদ চাষ (কাঁকড়া, ওয়েস্টার, মুজেল, সি-উইড, সি কুকুম্বার) করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

তা-ই নয়, সি ফুড প্রসেসিং করে এবং বায়োটেকনোলজিগত (ফাংশনাল ফুড, মেডিসিন, কসমেটিক্স সামগ্রী উৎপাদন) উন্নয়ন সম্ভব এই সুনীল অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে। কিন্তু এসব বিষয়ে এখনো যথাযথ কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সুনীল অর্থনীতি বিকাশে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তারমধ্যে অন্যতম হলো সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ চিহ্নিতকরণ ও স্টক জরিপ।

এ ছাড়াও রয়েছে রিসোর্স ম্যাপিং এন্ড জোনিং, গভীর সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণে পর্যাপ্ত সক্ষমতা না থাকা, আহরণ ব্যবস্থাপনায় মনিটরিং, কন্ট্রোল ও সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন না হওয়া, পর্যাপ্ত নীতিমালা ও দক্ষ জনশক্তির অভাব।

×