ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

প্রতিবন্ধী ফারহানের ছবির সম্মানি ১ লাখ

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ৩ আগস্ট ২০২২

প্রতিবন্ধী ফারহানের ছবির সম্মানি ১ লাখ

প্রতিবন্ধী ফারহান 

অভাবী সংসারের ১৯ বছর বয়সী ফারহান খানের বাক ও শ্রবণশক্তি নেই। তবে দারুণ মেধাবী। ইশারাতেই বুঝতে পারেন, কী বলা হচ্ছে তাকে। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসেন ফারহান। 
তার সবকিছুর সহযোগী মা রেক্সোনা আক্তার। সম্প্রতি মা-ছেলের দীর্ঘ কষ্টের স্বীকৃতি মিলেছে। বাগেরহাট বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারহানের আঁকা একটি ছবি ছাপা হয়েছে বাংলা নববর্ষ-১৪২৯ এবং পবিত্র ঈদুল ফিতর-২০২২ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা কার্ডে। এই ছবির সম্মানি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে তাকে দেওয়া হচ্ছে এক লাখ টাকা।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার আফরোজা বিনতে মনসুর গাজী লিপির সই করা এক চিঠিতে এই সম্মানির কথা জানানো হয়। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী কিশোর ফারহানের এমন সফলতায় আনন্দের জোয়ারে ভাসছেন মামা-বাবা-স্বজন-সহ তার সহপাঠি, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সকলে। তাদের দাবি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও যথাযথ সহায়তা পেলে খ্যাতিমান চিত্রকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ফারহানের।

ফারহান খান বাগেরহাট শহরের কেবিবাজার এলাকার মোশারেফ খাঁন ও রেক্সোনার ছোট ছেলে। জন্মের পরেই ছেলের সমস্যা বুঝতে পেরেছিলেন মা। ছেলেকে সুস্থ করতে ঘুরেছেন বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকের দ্বারে দ্বারে। 

কিন্তু কোনো কিছুতেই সুফল মেলেনি।  তারপরও থেমে থাকেননি ফারহানের পরিবার। ছেলেকে শিক্ষিত করতে ভর্তি করান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দুই বছরের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াশুনা চালাতে পারেননি ফারহান। 

পরে বাগেরহাট বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় তাকে। কথা বলা ও শ্রবণ শক্তি না থাকলেও ইশারায় সবকিছু বুঝে নেয় ফারহান। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার দারুণ সখ্য। সহপাঠিদের সঙ্গে হেসে খেলে দিন যায়। তবে তার শরীর কিছুটা দুর্বল। তাই তো সব সময় ছেলের সঙ্গে মাকে থাকতে হয়।

ফারহান খানের মা রেক্সোনা বলেন, আমার ছেলে ফারহান জন্মের পর থেকেই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, কোনো কাজ হয়নি। ছেলেকে মানুষ করার জন্য আমি সব ধরনের চেষ্টা করেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির পর শিক্ষকরা আর স্কুলে রাখতে চায়নি। 

পরবর্তীতে বাগেরহাট বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ভর্তি করি। এখানে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে অনেক কিছু শিখেছে। ছোটবেলা থেকে ও ছবি আঁকত। মাটি ও চক দিয়ে ছবি এঁকে অনেক দেওয়াল নষ্ট করেছে সে। তারপরও আমি তাকে উৎসাহ দিয়েছি। এবার আল্লাহর ইচ্ছায় জাতীয় পর্যায়ে “বাংলা নববর্ষ-১৪২৯ এবং পবিত্র ঈদুল ফিতর-২০২২” এর শুভেচ্ছা কার্ডে আমার ফারহানের ছবি ছাপা হয়েছে। 

আমি অনেক খুশি হয়েছি। এর আগেও ফারহান স্কুল, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছে। প্রতিটা পুরস্কারে ও নিজেকে আলাদাভাবে খুঁজে পায়। যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন ওর সুখের জন্য সবকিছু করে যাব। সংসারে অনেক অভাব। অসুস্থ থাকার পরও স্বামী একটি কোম্পানিতে চাকরি করে, আর বড় ছেলে বাসার সামনে একটি দোকান দিয়েছে। ফারহানকে ছবি আঁকা শেখাতে একজন ভাল শিক্ষক দেওয়ার মত সামর্থ্য আমার নেই। 

সরকারিভাবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে আমার ফারহানকে চিত্রাঙ্কন শেখালে আমার মনে হয় ও জগত বিখ্যাত চিত্রকর হতে পারত।

ফারহানের সহপাঠী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সজিব চক্রবর্তী বলেন, ফারহান ভাই অনেক ভাল। সব সময় আমাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। কখনও রাগ করে না। ভাই পুরস্কার পাওয়ায় আমরা খুব খুশি হয়েছি। শুধু সজিব নয়, বাগেরহাট বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থী শিক্ষক ও কর্মচারী সবাই খুশি ফারহানের সাফল্যে।

বাগেরহাট বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক দিপান্বিতা পাল বলেন, ফারহান অনেক শান্তশিষ্ট একটি ছেলে। ইশারার মাধ্যমে সে সবকিছু বলে। শেখার জন্য নিজে নিজে অনেক চেষ্টা করে ও পুরস্কার পাওয়ায় আমরা সবাই অনেক খুব খুশি। ভালো কোনো চিত্রকরের মাধ্যমে ছবি আঁকা শেখানো গেলে, ফারহান অনেক ভালো করতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী। 

প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ছবি পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে সহকারী শিক্ষক শারমিনা আশরাফি বলেন, বিভিন্ন সময় আমরা জেলা প্রতিবন্ধী কর্মকর্তার দপ্তরে আমাদের শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি জমা দেই। সেই ছবি তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠান। সেখান থেকে ছবি যাচাই-বাছাই করে ছাপানো হয় শুভেচ্ছা কার্ডে। প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের আঁকা ছবি ছাপানোর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের ক্ষমতায়নে কাজ করছেন। এজন্য তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।

বাগেরহাট প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি প্রাক্তন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মীর শওকাত আলী বাদশা বলেন, প্রতিবন্ধীরা কখনও বোঝা নয়। সঠিক পরামর্শ ও উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এরাও অনেক ভালো কিছু করতে পারে। আমাদের শিক্ষার্থী ফারহান খান এর জলন্ত প্রমাণ। এর আগেও আমাদের এই বিদ্যালয় থেকে দুইজন শিক্ষার্থী অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলম্পিকে অংশগ্রহণ করে স্বর্ণ পদক জিতেছিল। আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা গর্ব করি। এর আগে কোনো সরকার প্রতিবন্ধীদের নিয়ে এভাবে ভাবেননি। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম প্রতিবন্ধীদের ছবি শুভেচ্ছা কার্ডে ব্যবহার করছেন। এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের ক্ষমতায়ন ও ভালো রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ট বাঙ্গালী জাতির পিতার কন্যা। এজন্যই আজ প্রতিবন্ধীরা সম্পদ উঠছে, মেধা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। 

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান উচ্ছাস প্রকাশ করে বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন প্রতিটি মানুষের যাতে মর্যাদার সাথে মেধা বিকাশের সুযোগ পায়, সে জন্য সরকারীভাবে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহন করে তা যথাযথ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরীক।’ বাগেরহাট বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর আঁকা ছবি বাংলা নববর্ষ-১৪২৯ এবং পবিত্র ঈদুল ফিতর-২০২২ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা কার্ডে ছাপা হয়েছে- যা বাগেরহাটবাসী সকলের জন্য গর্বের, আনন্দের বলে তিনি উল্লেখ করেন। 

 

×