স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবসময়ই ছিলেন সোচ্চার ও সচেতন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রাম শুরু হওয়ার পূর্বে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালে এসে বিএম কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সভা করে ছাত্রদের সংগঠিত করেছেন।
ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের এ সভাই ছিল বরিশালের প্রথম সভা। পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালে সভা করে ঢাকায় যাওয়ার পর বাংলা ভাষার দাবিতে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট করে সেক্রেটারিয়েট ঘেরাও করা হয়। ওইদিন শেখ মুজিবুর রহমানসহ বরিশালের গৌরনদী থানার সন্তান কাজী গোলাম মাহবুব ও সরদার ফজলুল কবির গ্রেফতার হন। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণ ছিলো সেসময়কার অগ্রণীদের মতোই। এজন্য রাজবন্দী হয়ে কারাগারে থেকেও ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাবরণ করেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কাজী গোলাম মাহবুব সক্রিয় ভূমিকা পালন করায় তৎকালীন পাকিস্তানের প্রশাসন তার ওপর হুলিয়া জারি করেছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের সূচনা বিকাশ ও সফল পরিনতিতে যে সকল ভাষা সৈনিকের নাম ইতিহাসে পাতায় উজ্জল নক্ষত্রের ন্যায় প্রজ্জলিত তাদের মধ্যে অন্যতম কাজী গোলাম মাহবুব। ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পর আজও বরিশালের গৌরনদী উপজেলার লাখেরাজ কসবা গ্রামের এ কৃতি সন্তান নিজ এলাকায় অবহেলিত।
সূত্রমতে, ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। গৌরনদীর লাখেরাজ কসবা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে সরকারীভাবে তার নিজ এলাকা গৌরনদী উপজেলা পরিষদ চত্বরকে ভাষা সৈনিক চত্বর হিসেবে নামকরণ করা হয়। ওই চত্বরেই সু-বিশাল শহীদ মিনার ও একটি তোরণ নির্মান করা হয়েছিলো। ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দাবি রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ভাষা সৈনিক চত্বর ও তোরণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে রয়েছে সু-বিশাল শহীদ মিনার। এমনকি সরকারীভাবে এ ভাষা সৈনিকের জন্ম, মৃত্যু কিংবা বিশেষ কোন দিবসে আজো কোন কর্মসূচী পালন করা হয়নি। এমনকি সরকারীভাবে ভাষা সৈনিকের নিজ এলাকায় কোন শহীদ মিনার পর্যন্ত নির্মিত হয়নি।
সম্প্রতি সময়ে এ ভাষা সৈনিকের স্মৃতি রক্ষার্থে গঠিত “ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশন”র উদ্যোগে তার সমাধী সংলগ্ন এলাকায় একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ভাষা সৈনিকের নামে পারিবারিক ও ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গৌরনদীর নীলখোলা নামক এলাকায় নির্মিত পাঠাগার এবং স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রটিও চলছে ঢিমেতালে।
এলাকাবাসী সরকারীভাবে ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের নামে গৌরনদীতে একটি মিউজিশিয়াম ও পাঠাগার নির্মাণসহ গুড়িয়ে দেয়া চত্বর ও তোরণ নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশনের গৌরনদী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম জহির বলেন, গৌরনদীর লাখেরাজ কসবা গ্রামের বাসিন্দা কাজী আব্দুল মজিদ এবং আছিয়া খাতুন দম্পত্তির কোলজুড়ে ১৯২৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন কাজী গোলাম মাহবুব। তিনি ১৯৪২ সাল থেকে পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি কাজী গোলাম মাহবুব ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ১১মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে হরতাল পালনকালে তিনি গ্রেফতার হন। তিনি ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি ১৯৫২ সালে গ্রেফতার হয়ে এক বছর কারাবরণ করেন।
১৯৪৯ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এ ভাষা সংগ্রামী আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য এবং ১৯৫৩ সালে বৃহত্তর বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সফলতা অর্জনের পর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
জহুরুল ইসলাম আরও বলেন, ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনে কাজী গোলাম মাহবুব বিরোধীতা করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দিয়ে দলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং রাজনৈতিক গবেষণা কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য কাজী গোলাম মাহবুব ১৯৯৩ সালে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম রাষ্ট্রভাষা স্বর্ণপদক, ১৯৯৮ সালে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জোট পদক, ২০০০ সালে তমদ্দুন মজলিশের মাতৃভাষা পদক, ২০০২ সালে একুশে পদক এবং একই বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাষা সৈনিক পদকে ভূষিত হন। ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ তার মৃত্যুর পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন তার নামে ধানমন্ডির ১০ নাম্বার সড়ককে “ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব সড়ক” হিসেবে নামকরণ করলেও তার জন্মস্থান গৌরনদীতে ভাষা সৈনিকের নামে সরকারী উদ্যোগে নেই কোন স্মৃতি চিহ্ন।