ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘গ্রেট পাওয়ার গেম’

প্রকাশিত: ০৯:১০, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

‘গ্রেট পাওয়ার গেম’

১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল রবিবার। আজ ২৫ মার্চের সেই কালরাতের পর ছয় মাস গত হয়েছে। এই ছয় মাসে ইতিহাস দেখেছে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর নারী-শিশুর প্রতি নারকীয় অত্যাচার ও অনাচার। তাদের অনাচারের প্রাথমিকভাবে প্রায় ১০ লাখ মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রক্তলালসায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ দিয়েছে; ৯০ লাখ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে যেখানে শরণার্থী শিবিরে মহামারী এবং অপুষ্টি তাদের সংখ্যায় কমিয়ে আনছে; এবং আরও কয়েক মিলিয়ন উদ্বাস্তু মানুষ বাংলাদেশের মধ্যে ভাসমান অবস্থায় ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ইয়াহিয়া বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে দুর্ভিক্ষের আগমন, যার জন্য ইসলামাবাদ জান্তা গভীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ। এ অনিবার্য দুর্ভিক্ষ, যার পথ পাকিস্তান গড়ে দিয়েছে শস্যের ধ্বংসসাধন এবং চাষীদের ক্ষেত থেকে উৎখাতের মাধ্যমে, তা যে শুধু বাংলাদেশের আরও একটি অংশ ধ্বংস করবে তাই নয়, বরং বুভুক্ষু মানুষকে খাবারের বিনিময়ে হানাদার বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে। বাঙালীর জনসংখ্যা কমিয়ে আনার এতসব গণহত্যামূলক চক্রান্ত তবেই অর্থবহ হতো, যদি বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকত। কিন্তু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালী জনসাধারণের বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনীর এ নীলনকশা শুধুই ঘৃণ্য অনাচার, যার সফলতা ইহুদী সমস্যার বিরুদ্ধে হিটলারের ‘চূড়ান্ত সমাধান’ এর চাইতেও কম! আরও একটি শিক্ষা হলো যে, দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় ও সশস্ত্র বাহিনীকে সংঘবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। হানাদারদের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধের শক্তি এবং মুক্তিবাহিনীর সাফল্যগুলো প্রায় প্রতিদিনই নিরপেক্ষ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে স্বীকৃতি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে, বাংলাদেশ ‘গ্রেট পাওয়ার গেম’-এর শিকার হিসেবেই রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় জনসমর্থনের ভিত্তিতে উদ্ভূত নতুন একটি রাষ্ট্রকে বরণ করে নেয়ায় অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাভাবিক অনাগ্রহ ছাড়াও অদ্ভুতভাবে পাকিস্তানে আমেরিকা ও চীনের মিলিত স্বার্থ কুচক্রীজান্তাকে ইসলামাবাদে ক্ষমতায় রেখেছে, যা একে বাংলাদেশে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার উদ্যম সরবরাহ করছে। ৯০ লাখ শরণার্থীর চাপে জর্জরিত ভারত ঘটনাপ্রবাহে এই অপেক্ষা ও আশায় আছে যে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র প্রচেষ্টা ইয়াহিয়া বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে পিছু হটতে বাধ্য করবে এবং শরণার্থীদের নিজ মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন দর্শকের ভূমিকায় অপেক্ষমাণ, নবউদ্ভূত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের টিকে থাকার সম্ভাবনা যাচাই করছে। এই দিন নওয়াবগঞ্জে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পেয়ে পাকসেনারা লঞ্চে করে বড় খাল দিয়ে নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিফৌজের গেরিলাদের ৪০ জনের আরেকটি দল পাকসেনাদের লঞ্চটিকে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের সময় অতর্কিত আক্রমণ করে। অতর্কিত আক্রমণের ফলে ৩ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। পাকসেনারা লঞ্চটির দিক পরিবর্তন করে দ্রুত নাগালের বাইরে চলে যায়। মুক্তিফৌজ পকিবাহিনীর গুথুমা বিওপি-তে আক্রমণ করে। মুক্তিফৌজের সৈনিক নায়েক হারিস মিয়া হামাগুড়ি গিয়ে কয়েক গজ দূরের একটি বাঙ্কারে গ্রেনেড ঢুকিয়ে দেয়। অন্যরাও কয়েকদিক দিয়ে আক্রমণ চালায় এবং পরে রাতের অন্ধকারে নিরাপদে সরে আসে। ২ জন পাকসেনা আহত হয়। সকাল ১০.৩০ মিনিটে দেভপুরে আরেকটি এ্যামবুশে ৬ জন পাকসেনা আহত হয়। এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের ফলে একজন সাধারণ মানুষ আহত হয়। ফেনি নদীতে আন্দারমানিক বিওপি ছিল পাকসেনাদের শক্তিশালী অবস্থান। প্রতি সন্ধ্যায় সকালে সৈন্যরা ফলোইন এবং সকালে রোলকল করা হয়। এই খবরে মুক্তিফৌজের একটি এ্যামবুশ পার্টি বিওপি তে এ্যামবুশ পাতে। রোলকল শেষের সঙ্গে সঙ্গে এলএমজি ও রাইফেল দিয়ে আক্রমণ শুরু হয়। এই সময়ে পাকসেনারা তাদের ট্রেঞ্চ ও বাঙ্কারে লুকানোর চেষ্টা করে। ১ জন জেসিওসহ মোট ১৫ জন আহত হয়। এই দিন সর্বমোট ২ প্লাটুন পাকসেনাকে রোলকলের জন্য একত্রিত করা হয়। ২নং সেক্টরে ২৫০ সদস্যবিশিষ্ট পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দল রামগঞ্জ বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর ৫০ জন যোদ্ধার একটি দল রামগঞ্জ বাজারের পূর্বদিকে পাকসেনাদের জন্য এ্যামবুশ পাতে। পাকসেনা ও রাজাকারের দল অগ্রসর হওয়ার পথে এ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ২০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত এবং ২৭ জন আহত হয়। ৪নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ৬০ জন যোদ্ধার একটি দল কুমারসাইলে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে এক অভিযান চালায়। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে আড়াই ঘণ্টা গোলা বিনিময় হয়। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৯ জন সৈন্য নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। ৫নং সেক্টরের তামাবিল সাব-সেক্টর ব্রেভো কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে মোঃ রফিকুল আলম কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৮নং সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকবাহিনীর দত্তনগর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ২ জন সৈন্য নিহত ও ২ জন আহত হয়। ঢাকার গোপীবাগে শহর মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ হোসেনের বাসভবনে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এতে পাহারাদারদের সঙ্গে গেরিলাদের প্রচ- গুলিবিনিময় হয়। তবে কোন হতাহত হয়নি। মুক্তিবাহিনী গোপালগঞ্জ মহকুমার রায়চন্দ্রপুরে মধুমতি নদীতে পাকিস্তানীদের খাদ্য ও অস্ত্র বোঝাই ৪টি নৌকার ওপর দুঃসাহসিক অভিযান চালায়। এই অভিযানে পাকবাহিনীর দুটি নৌকা ডুবে যায় এবং ১৫ জন রাজাকার ও ২ জন পাঞ্জাবী পুলিশ নিহত হয়। রাজশাহী সীমান্তে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি দলকে অতর্কিত আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকসেনা দলের সকল সদস্য নিহত হয়। নৌকমান্ডো সাব-লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ রহমতুল্লাহর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ন্যাভাল কমান্ডোদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতিক্রমে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বন্দরে অবস্থানকারী পাকিস্তানী ও বিদেশী জাহাজসমূহ ধ্বংস ও নদীপথ সম্পূর্ণভাবে অচল করার পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭৮ জন প্রশিক্ষত কমান্ডোকে ৪ ভাগ করে প্রেরণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ ব্রিগেডিয়ার সালেকের নির্দেশনায় নৌকমান্ডো সাব-লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ রহমতুল্লাহসহ ১১ জনকে খুলনায় অপারেশনে পাঠানো হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×