ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

প্রতাপ হাজরাকে কাঁদায় সোনালি স্মৃতি

প্রকাশিত: ০১:৫৫, ৬ এপ্রিল ২০২২

প্রতাপ হাজরাকে কাঁদায় সোনালি স্মৃতি

গুগোলে উরুগুয়ে-আর্জেন্টিনা সার্চ দিলেই চলে আসে ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচের ভিডিও ক্লিপ। তেমনি চোখ বন্ধ করে যদি স্মৃতির পাতায় ফুটবল হাতড়ে বেড়াই তাহলে মোহামেডান-আবাহনী দ্বৈরথের দৃশ্য চোখে ভেসে আসে। চোখ বন্ধ করেই যেন হারিয়ে যাই সেসব দিনগুলোতে। আমার খেলোয়াড়ী জীবনের শুরু আবাহনী সৃষ্টির অনেক পূর্বে হলেও এই দুই দলের মোকাবেলার স্মৃতি আমার কাছে উজ্জ্বল। আবাহনী- মোহামেডান ম্যাচ আমার কাছে এক অন্যরকম ভাললাগা আর ভালাবাসার মুহূর্ত। আমি ১৯৬১-১৯৬২ এই দুই বছর ভিক্টোরিয়াতে খেলি। পরের বছরের জন্য কবির ভাই আমাকে বশিরের সঙ্গে মোহামেডানে নিয়ে আসেন। ঠিক তখন থেকেই শুরু খেলোয়াড়দের পেমেন্ট প্রথা যা আজ আকাশচুম্বী। কথাগুলো ফুটবলের এক আড্ডায় বলেছেন বাংলাদেশের ফুটবলের উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রতাপ শংকর হাজরা। প্রতাপ হাজরা ভিক্টরিয়াতে ১৯৬১-৬২ সালে, মোহামেডানে খেলেছেন ১৯৬৩-৬৭ পর্যন্ত। সহ-অধিনায়ক ছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের। তাছাড়া স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। হকিতে ১৯৫৭-১৯৫৯ পর্যন্ত ওয়ারী, ১৯৬০-৬২ ভিক্টোরিয়া, ১৯৬৩-৭০ কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব, ১৯৭২-৭৪, ১৯৭৮-৮২ মোহামেডান, ১৯৭৫-৭৭ আবাহনী দলের খেলোয়াড় ছিলেন। ক্রিকেটে ১৯৭৩-৭৫ শান্তিনগর, ১৯৭৭-৭৮ মোহামেডান দলের হয়ে খেলেছেন। প্রতাপ হাজরা ২০০১ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন। প্রতাপ শংকর হাজরা তিন জনপ্রিয় খেলা ফুটবল হকি এবং ক্রিকেট খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। বাংলাদেশের হয়ে ফুটবল এবং হকি দুটিতেই খেলেছেন জাতীয় দলে। ১৯৭৭-৭৮ ক্রিকেট মৌসুমে খেলোয়াড় সঙ্কট দেখা দিলে প্রতাপ মোহামেডানের হয়ে মাঠে নামেন এবং ওই বছর লীগসহ তিনটি শিরোপা জয় করে বিখ্যাত সাদা-কালো জার্সিধারীরা। আড্ডায় অনেক মজা মজার আলোচনা হয়েছে যার চুম্বক অংশ তুলে ধরছি। প্রতাপ দা’র সেদিনের খেলার সালটা মনে নেই। গোপালগঞ্জ সুগার মিলের দুই বিভাগের জম্পেশ লড়াই যা মনে হলে আজও শিউরে উঠেন তিনি। ক্রিকেটার খালেদ মাসুদের চাচা জালু একটা দলে খেলার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন প্রতাপসহ অমলেশ সেন, নান্নু এবং গোলরক্ষক হিসেবে বর্তমানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে। বিপক্ষের দলটিও ছিল খুবই শক্তিশালী। সেখানকার স্থানীয় দু একজন ছাড়া সবই ঢাকার তারকা খেলোয়াড়। রাইট ব্যাক ফারুক, লেফট ব্যাক জহিরুল, মেইন ডিফেন্স পিন্টু, ফরোয়ার্ড টিপু এবং গোলরক্ষক হাজী কাশেম। প্রতাপদের যিনি গোপালগঞ্জ নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি খেলার শুরুতে প্রশ্ন করেন খেলার ফলাফল কি হতে পারে? জবাবে খুব সাবলীল ভঙ্গিতে প্রতাপ উত্তর দিয়েছিলেন চার শূন্য! ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর বিপক্ষ দল আর মাঠে নামেনি। ট্রফিটা প্রতাপের দলকে দিয়ে দিতে বলেন। খেলা শেষে দলের ম্যানেজার তাঁর বাসায় নিয়ে যায় প্রতাপকে। তোশক উল্টিয়ে প্রতাপকে জিজ্ঞেস করেন ইয়া ক্যায় হায়? প্রতাপ কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেন ইয়ে বন্দুক হ্যায়! চাদরের নিচ থেকে একটা চিরকুট বের করেন যেখানে লিখা ছিল ‘নো বডি রেস্পনসিবল ফর মাই সুসাইড।’ খেলায় হেরে গেলে সেদিন সে এই বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করতেন। অতঃপর সেই ম্যানেজারের স্ত্রী কন্যা এসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। স্মরণীয় গোলের ব্যাপারে তিনি জানান ১৯৬৮ সালের আগাখান গোল্ড কাপের ফাইনালের করাচীর পোর্ট ট্রাস্ট দলের বিপক্ষে। খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়। গোলটা সরাসরি কর্নার থেকে করেছিলেন প্রতাপ। ৫/৬ টা গোল আছে সরাসরি কর্নার থেকে। প্রতাপের বাবা প্রিয় শংকর হাজরা কখনোই চাননি প্রতাপ খেলোয়াড় হোক। তিনি জানতেনও না তাঁর ছেলে এখন ঢাকা লীগের নামকরা খেলোয়াড়দের একজন। ছেলে যে বড় খেলোয়াড় হয়ে গেছে তা জেনেছেন পত্রিকা মারফত। বাসায় তখন রাখা হতো ইত্তেফাক তবে সেদিন অবজারভার দিয়ে গেছে। অবজারভারে প্রায়শই প্রতাপের ছবি ছাপা হতো। যে কারণে নাকি প্রতাপের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘অবজারভার বেবি’। প্রতাপ একটা শট নিচ্ছেন পোস্টে এমন ছবি ছাপা হয়েছিল যা সেদিন দৃষ্টিগোচর হয়েছিলো বাবা প্রিয় শংকর হাজরার। সেদিন বুঝেছিলেন তাঁর ছেলে বড় খেলোয়াড় হয়ে গেছে। ১৯৬৩ সালের ঘটনা। তখন ঢাকা জেলা প্রশাসক আব্দুল মালেক। প্রতাপের বাবা ডিসি কোর্টে গেলে দেখা হয় ডিসি আবদুল মালেকের সঙ্গে, আব্দুল মালেক তখন ভিক্টোরিয়া ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। মালেক সাহেব প্রতাপের বাবাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি আজ তাঁর ক্লাবে যাবেন কি না, উত্তরে প্রিয় শংকর হাজরা বলেন কেন? আব্দুল মালেক বলেন আপনার ছেলে আমার ক্লাবের খেলোয়াড়, আজ তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। প্রতাপের বাবা এবার রাজি হলেন এবং সে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। প্রতাপ সে অনুষ্ঠানে একটা হাত ঘড়ি ও ক্রেস্ট পেয়েছিলেন। প্রতাপের বাবা প্রিয় শংকর হাজরা সেদিন ছেলের সাফল্যে আনন্দে প্রথম চোখ ভিজিয়েছিলেন। আলচনায় উঠে আসে মোহামেডান-আবাহনী দ্বৈরথ। মোহামেডান আবাহনী দ্বৈরথ নিয়ে কথা হলে তিনি ১৯৭৫ সালের ঘটনা টেনে আনেন। তিনি বলেন, সবার মুখে মুখে যখন আবাহনীর নাম তখন ১৯৭৫ সালে মোহামেডান আবাহনী ম্যাচ নিয়ে চলছে গুঞ্জন। সেবার মোহামেডানে যোগ দেয় শামছুল আলম মঞ্জু। আবাহনীতে আছে তারই সহোদর মনোয়ার হোসেন নান্নু। লীগ ম্যাচ মোকাবেলায় মোহামেডান আবাহনী। সারাদেশ যেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। স্কুল কলেজ অফিস আদালত সবার মুখে মুখে মোহামেডান আবাহনী একই আলোচনা। আমাদের অন্যান্য খেলোয়াড়রা যেন টেনশনে পড়ে যায় তবে আমি বরাবরই বলে এসেছি মোহামেডান জিতবে। খেলার দিন উভয় গ্যালারি দর্শকে পরিপূর্ণ। কোচ জহির ভাই আইনুলকে বলে দেয় সালাহউদ্দিনকে পুরো মার্কিংএ রাখতে। আইনুল যেন কোচের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। মোহামেডান সেদিনের মর্যাদার লড়াইয়ে ৪-০ গোলে আবাহনীকে পরাজিত করে। গোল করেছিল নওশের, গাজী, হাফিজ উদ্দিন এবং মইন। রিটার্ন লীগে মোহামেডান হারিয়েছিলো আবাহনীকে ১-০ গোলে। একমাত্র গোলদাতা নওশের। এরপর থেকেই মোহামেডান আবাহনী ম্যাচ অন্যমাত্রায় চলে যায়। ১৯৬৩, ৬৫, ৬৬, ৬৯, ৭৫ এবং ১৯৭৬ সালে ফুটবলে মোহামেডানের চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন প্রতাপ। খেলা থেকে অবসরে যাওয়ার পরেও মোহামেডান ছাড়তে পারিননি। আজও মোহামেডানের জয়ে আনন্দিত এবং পরাজয়ে ব্যথিত হন। তিনি উল্লেখ করেন আমাদের আর্কাইভে ইদানীংকালের কিছু ম্যাচ থাকলেও ৭০-৯০ এর কোন খেলার ভিডিও পাওা যায় না যা দুঃখজনক । পুরনো দিনের মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ থাকলে এখনকার তরুন প্রজন্ম বুঝতে পারতো মোহামেডান আবাহনীর উত্তেজনা মাঠে এবং মাঠের বাইরে কি পরিমাণ ছিল। প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক নাজমুল আমিন কিরনের কাছে অনেক তথ্য ও ছবি আছে যা মাঝে মাঝে তাকে দেখালে নস্টালজিয়ায় ভুগতে থাকেন। তিনি সেসব দেখে রীতিমতো চমকে উঠেন। সরকারী পর্যায়ে এগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন প্রতাপ শংকর হাজরা।
×