ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাইরাল বৃত্তান্ত

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৮ জানুয়ারি ২০১৯

ভাইরাল বৃত্তান্ত

ভাইরাল শব্দটা আজ নিজেই ভাইরাল। ইন্টারনেটের কল্যাণে ভাইরাল শব্দটি এখন নৈমিত্তিক ব্যবহার করা একটি শব্দে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা কিন্তু বলেছেন, ভাইরালের উৎপত্তি ইন্টারনেটের জন্মের বহু পূর্বে। ১৭ শতকের শেষ দিকে কাগজে ধর্মীয় বার্তা লিখে ছড়িয়ে দেয়া হতো। নিচে এটাও উল্লেখ করা থাকত, যে এই বার্তাটির আরও কিছু কপি বানিয়ে যে ছড়িয়ে দেবে তার মঙ্গল হবে। বাড়তি হিসেবে জুড়ে দেয়া হতো আবার কোন ভয়ঙ্কর উদাহরণ। যেমন এই বার্তাটি ছড়িয়ে না দেয়ার কারণে কোন একজনের ভীষণ ভয়ানক মৃত্যু হয়েছে। ধর্মভীরু মানুষ এভাবেই কোন বার্তার সম্পূর্ণ মর্ম না বুঝেই প্রবল উৎসাহে সেটা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিত। পুরো প্রক্রিয়াকে বলা হতো চেইন লেটার। এটাই ভাইরালের আদিরূপ। ইউরোপের অনেক ধর্ম প্রচারক সংঘও এভাবে অর্থ সংগ্রহ করত। সে যুগে যে শুধু ধর্মীয় ব্যাপার স্যাপারই শুধু দাবানলের মতো ছড়াত সেটা কিন্তু নয়। মধ্যযুগে সিল্করুটের বদৌলতে ফ্যাশন এবং স্থাপত্যশিল্পের অনেক ডিজাইনও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘থ্রি হেয়ার’ নামের একটি ডিজাইন লন্ডন, ইউরোপ, অটোমান, পারস্য, আফগান এবং চীন সা¤্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর এলো ফ্লপি ডিস্ক, ক্যাসেট, সিডির যুগ। মোটামুটি আকারে ছোট বলে চিঠি বা পার্সেল করে কোন অডিও বা ভিডিওকে অনেক দূরে পাঠানো যেত। নির্মাতারা প্রায়ই ফ্রি কপি বিতরণ করতেন। এছাড়াও টিভি থেকে রেকর্ড করেও প্রচুর কপি বাজারে ছেড়ে দেয়া হতো। ১৯৯৯ সালে ঞযব ইষধরৎ ডরঃপয চৎড়লবপঃ সিনেমার মার্কেটিংকে অন্যতম সেরা ভাইরাল মার্কেটিং বলা হয়। সিনেমার নির্মাতারা এমনভাবে কিছু দৃশ্য তৈরি করেছিল যাতে মনে হবে ভিডিওগুলো কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে নেয়া। দর্শকরাও ভেবে বসে বাস্তবের কোন নিখোঁজ ব্যক্তির পাওয়া কিছু ভৌতিক ফুটেজ ব্যবহার করে পরের গল্প তৈরি করা হয়েছে। ১ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ২৫০ মিলিয়ন ডলার তুলে নিয়েছিল সিনেমাটি। ইন্টারনেটের প্রথম যুগে চেইন লেটারের বদলে এলো চেইন মেইল। বানোয়াট খবর, গুজব ছড়ানো ছাড়াও টাকা পয়সা হাতিয়ে নিতেও চেইন মেইলিং করা হতো। তবে সবসময় যে আবার খারাপ কাজ করা হতো তা কিন্তু নয়। ইরাক আগ্রাসন রুখতে মার্কিনীরা ২০০২ সালেও চেইন মেইলিং করেছিল যেখান থেকে অন্তত ৩৩০০০ সাইন সংগ্রহ করা হয়। ২০০৬ সাল নাগাদ ইউটিউব দিনে ৬৫ হাজারের বেশি ভিডিও আপলোড হতো। বলতে গেলে ইউটিউব নিজেই একটি ভাইরাল সাইটে পরিণত হয়। রোনালদিনহোকে নিয়ে নির্মিত ‘টাচ অফ গোল্ড’ নামের একটা ভিডিও প্রথম ১ মিলিয়ন ভিউ অর্জন করে। বর্তমান সময়ে মিলিয়ন ভিউ ডালভাত হলেও ২০০৫ সালে মিলিয়ন ভিউ পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। মিলিয়নের পর আসে বিলিয়ন যুগ। বিশ্ব মাতানো গ্যাংনাম হয় ইউটিউবের প্রথম বিলিনিয়ার। ভাইরাল শব্দটি প্রথম ব্যাপকভাবে নজরে আসে ফেসবুকের পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। ফেসবুকের সঙ্গে সঙ্গে যেন ভাইরাল শব্দটি নিজেও সীমানা বাড়াচ্ছিল। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে যে কোন কন্টেন্টের ভাইরাল হওয়ার প্রবণতাও বাড়ছিল। একটা সময় অন্য যে কোন সাইটের চেয়ে মানুষের ফেসবুকে বেশি সময় ব্যয় করার প্রবণতা দেখা দেয়। নিজের জীবনে প্রতিদিন ঘটা ঘটনা বা অন্য যে কোন কিছু নিয়েই শোরগোল তোলার প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় ফেসবুক। প্রযুক্তির গতিশীলতায় কোন কন্টেন্ট যেমন দ্রুত ভাইরাল হতে শুরু করে, একইভাবে দ্রুতই বিলীন হতে শুরু করে। কারণ কিছুক্ষণ পরেই হয়ত নতুন কোন কন্টেন্ট এসে পুরনো ভাইরাল কন্টেন্টের স্থান নিয়ে নিত। ‘কোন কিছু ভাইরাল হওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে তা যেন মানুষের মন বা আবেগকে স্পর্শ করে। এখন তা হাসি, বিনোদন কান্না বা ক্রোধ যাই হোক না কেন।’ জানালেন ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ হিমেল হাসান। মন বা আবেগ স্পর্শ করা ছাড়াও আরও কিছু বিষয় কোন কন্টেন্ট ভাইরাল হওয়ার জন্য ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। ফেসবুক, ইউটিউব থেকে শুরু করে সব ওয়েব প্ল্যাটফর্মেও দেখাশোনার বড় দায়িত্ব পালন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ফেসবুকের কথাই বলা যাক। কোন পোস্টকে নিউজফিডের উপরে রাখা হবে না একেবারে শেষদিকে ফেলে রাখা হবে এটা কিন্তু কোন মানুষ ঠিক করে দেয় না। আবার নিউজফিডেই কতটা উপরে রাখা হবে সেটাও ঠিক করে দেয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রথম কয়েক ঘণ্টায় কোন পোস্ট কতজন দেখল, কতজন শেয়ার করল, পোস্ট করার সময় কি বয়সের ব্যবহারকারীরা পোস্ট দেখছে, কোথা থেকে দেখছে- এ রকম ছোট ছোট অনেক বিষয় বিবেচনা করে এ্যালগারিদমই কন্টেন্টের পরিধি ঠিক করে দেয়। সাড়া পেলে এ্যালগরিদম নিজেই ওই পোস্টটি বেশি করে নিউজফিডে দেখায়। বড় বড় বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো এ্যালগারিদম বিশ্লেষণ করে তাদের কন্টেন্ট ভাইরাল করার জন্য হাজার হাজার ডলার খরচ করে ডিজিটাল মার্কেটার নিয়োগ দেয়। টুইটার বা ইন্সটাগ্রাম, ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম হলেও কন্টেন্ট ভাইরাল হওয়ার রাস্তাগুলো একই। তবে সব প্ল্যাটফর্মই এখন কন্টেন্টের ভিড়ে এত গিজগিজে হয়ে দাঁড়িয়েছে যে মানসম্মত কন্টেন্ট ভাইরাল হয় খুব কম। এছাড়াও সরাসরি বিজ্ঞাপন এবং ৩য় পক্ষের মার্কেটিং ছাড়া কোন কন্টেন্ট ভাইরাল হওয়া খুব কঠিন। এখানেও কিন্তু আছে। বিষয় যদি হয় আবেগকে চরমভাবে নাড়া দেয়ার মতো তাহলে উপরের কোন সূত্রই আর খাটে না। সেলিব্রেটিদেও যে কোন ছবি বা ভিডিও, ট্রল-মিম যথেষ্ট দ্রুতই ভাইরাল হয়ে যায়। কোন কোন সময় খুব নেতিবাচকভাবেও বিখ্যাতদের ট্রল ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে। উদ্ভট, কিম্ভুতকিমাকার ভঙ্গির বক্তব্য, গান, অভিনয়ও হাসির খোরাক জুগিয়ে ভাইরাল হওয়ার দৌড়ে থাকে উপরের দিকে। তবে ভুয়া খবর বা গুজবের ক্ষেত্রে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ৎঁসড়ৎ রং ধ মৎবধঃ ঃৎধাবষষবৎ প্রবাদটা যেন একেবারে যথার্থ। ভুয়া খবর যখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায় সেই উত্তাপটা ভার্চুয়াল জগত থেকে বেরিয়ে আসে বাস্তব জগতে। গুজবে কান দিয়ে আজ অবধি দাঙ্গা হাঙ্গামা কম হয়নি। প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে অহরহ ভুয়া সংবাদ ভাইরাল করার মতো নিচু কাজ করতেও দ্বিধা করে না অনেকেই। তবে আশার ব্যাপার হলো মানুষ দিন দিন সচেতন হয়ে উঠছে। নেতিবাচক প্রভাব থাকলেও ভাইরালের ইতিবাচক দিকই বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে প্রায়ই এখন অনিয়মের গল্পগুলো অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। সাধারণ একজন মানুষের দুর্দশার কথা পৌঁছে যাচ্ছে প্রশাসনের উপর মহলের কানে। ঘৃণ্য ধর্ষক বা কুখ্যাত খুনীর ছবি একবার ভাইরাল হয়ে গেলে আর পালানোর সব পথ বন্ধ। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ সংগ্রহ, বাড়ি থেকে হারিয়ে যাওয়া কোন শিশুর মায়ের কোলে ফিরে যাওয়া-এসবও দেদার হচ্ছে ভাইরালের কল্যাণে। হয়ত এই প্রতিবেদনটি পড়তে পড়তেই ফোনে চলে এসেছে নটিফিকেশন। আরেকটি কন্টেন্ট হয়ত ভাইরাল হওয়ার পথে।
×