ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শত সম্ভাবনার ‘পথের ইশকুল’

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শত সম্ভাবনার ‘পথের ইশকুল’

ঢাকার গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চের পার্কটিতে রয়েছে চল্লিশটি গৃহহীন পরিবার। সবমিলিয়ে তাদের ছেলেমেয়ের সংখ্যাটা সত্তরের মতো। বলা চলে শতাধিক মানুষ রাত যাপন করে পার্কটিতে। এখানকার বাচ্চাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আরও দুবছর আগে এখানেই তিন স্বেচ্ছাসেবী সাকির মাটি, তারেক হাসান, মারজিয়া প্রভার নেতৃত্বে শুরু হয় ‘পথের ইশকুল’ নামের একটি পথের বিদ্যানিকেতনের। যখন তারা স্কুলটি শুরু করেন তখন এখানের বাচ্চাদের অভিভাবক, মাদকের ব্যবসায়ী সহ পার্কের অনেকেই সমর্থন দেয়নি। নানাভাবে বাঁধা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো, দীর্ঘদিন বোঝানোর পর চল্লিশেরও বেশি শিশুকে নিয়মিত স্কুলমুখী করতে সক্ষম হয় তারা। প্রতি শুক্র ও শনিবার বর্তমান স্বেচ্ছাসেবকদের নেতৃত্বে চলে পাঠদান, রয়েছে পাঠ্যক্রম। তাদের শেখানো হয় দৈনন্দিন জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেভাবে করা হয় তাও। এই ইশকুলের বাচ্চাদের জন্য খাবারের সামগ্রী নিয়ে এবং তাদের সঙ্গে আনন্দের সময় কাটাতে যারা কাজ করছেন তাদের পরিচয়টা দিয়েই শুরু করি- তাদের মধ্যে একজন সাকির মাটি যিনি পথের ইশকুল এর ডিরেক্টর, আর সৈকত হচ্ছে কো-অর্ডিনেটর। সৈকত জানালেন, আমাদের এক একটা প্রজেক্টের দায়িত্ব এক একজনের, প্রভাপু ডোনেট এ প্যাডের ডিরেক্টর, তারেক ভাই আমাদের রক্ত আমরাই দিব প্রজেক্টের। তবে আলাদা করে বললে দুই সাহসী তরুণ সাকির মাটি এবং তারেক হাসানের কারণেই আজ এতদূর। এটাকে বাস্তবে রুপান্তরিত করতে যে মানুষগুলো অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন বিনা পারিশ্রামিকে তারা হলেন মুরাদ, মহিদুল, সায়েম, অমিয়া, ফ্লোরা, দিপ্তি, ভাবনা, সুমাইয়া, ফাহিম, ইফাদ, আদর, সাগর, প্রিন্স, আসিফ, ফাহাদ। ইশকুলটির মাধ্যমে তারা চাইছেন পার্ক এলাকায় মাদকমুক্ত, বাচ্চাদের জন্য সহায়ক একটি পরিবেশ তৈরি করতে। পার্কে সরেজমিনে গিয়ে শুক্রবার দেখা গেল, বাচ্চাদের প্রিয় মাটি ভাই আসার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কোলে, কেউ হাত ধরে বসে আছে! পথের ইশকুলের অন্যতম সংগঠক মুরাদ জানালেন, ইশকুলটির বাচ্চারাও মেধাবী, তাদের জন্য পাঠ্যক্রম রেখেছি আমরা। শিক্ষার্থী ভিত্তিতে শিক্ষকও আলাদা। গল্পটা আরও কঠিন লাগবে যখন দেখবেন শিক্ষার্থীদের একজন শীলা, সে নিজেই ভিক্ষা করে। তার বাবা বাবুল মাতবর, যিনি বোবা ও বেকার, দুর্ভাগ্যজনকভাবে মা শিউলি আক্তার নিজেও বোবা, রয়েছে আরেকটা মেয়ে আয়শা যার বয়স ৫ বছর। আরেকটি পরিবারের গল্প শুনেন চমৎকার হাসির শাহজালাল তার বাবা লিটন, যিনি শরবত বিক্রেতা, লিটনের নেই মা তবে রয়েছে ৫ ভাই বোন! অবাক করা আরেকজন জীবন যে এবয়সেই মাদক বিক্রেতা, বাবা হুমায়ন পেশায় রিক্সাচালক, মা নেই জীবনেরও তবে রয়েছে ৩ ভাই বোন। এরাত শুধু পথের ইশকুলের তিনটি বাচ্চার ছোট্ট বিবরণ, পাঠক একটু ভেবেই বলুন কত বড় চ্যালেঞ্জজ এরকম ছেলেমেয়েদের জন্য একটা স্কুল তৈরি করে প্রতি শুক্র-শনি ক্লাস নেয়া। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা হলো, অনেকেরই খুব ইচ্ছা সন্তান পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে কিন্তু পার্ক সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাদকের করালগ্রাস একটু একটু করে ছোবল মারছে পুরো পার্কের শতাধিক শিশুদের। কথা হলো ‘পথের ইশকুলে’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তারেক হাসানের সঙ্গে, বললেন পথশিশুদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে চাই, পথশিশু কিংবা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটা স্থায়ী কর্মমুখী স্কুল খুলতে চাই। যাতে করে স্কুলে শিশুরা সব সুযোগসুবিধা পেয়ে বড় হবে। স্বপ্নের সবচেয়ে বড় কারিগর যিনি তিনি সাকির মাটি, সদা হাস্যোজ্জল এ তরুণের পরিচয় তিনি বাচ্চাদের প্রিয় মাটি ভাই। মাটি ভাই জানেন কোন পরিবারের কি অবস্থা, কে কতটুকু পড়ে, কার নাম কি, কার অর্থনৈতিক অবস্থাই কেমন! সাকির মাটি বললেন চমৎকার কিছু কথা - আমার স্বপ্ন হচ্ছে, বাচ্চাদের মাদক ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্ত করে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসা এবং বাচ্চাগুলোকে মানবিক গুণ সম্পন্ন একজন ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সমাজের বিত্তবান শ্রেণী যদি পথের ইশকুলের বাচ্চাদের দিকে একটু নজর দিতেন তবে বোধহয় এখান থেকেই জন্ম নিতে পারে ভবিষত বাংলাদেশের বড় কোন নাম। আমরা যেদিন স্কুলটিতে গিয়েছি সচক্ষে দেখতে পেলাম পুরোটা সময় পথের ইশকুলের এক শিশু মনের সব রং দিয়ে আঁকছিল স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজে ঘেরা পতাকা আর সম্মানের স্মৃতিসৌধ। চলেন ওদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করি... ডিপ্রজন্ম ডেস্ক
×