ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

শিশুশ্রম বন্ধ হবে কবে

মো. তানজিমুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৭:৫৬, ১৮ জুন ২০২৫

শিশুশ্রম বন্ধ হবে কবে

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ আমরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতিতে অনেকাংশেই এগিয়ে গেছি বৈকি! আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ আজ নানাভাবেই সুপরিচিত! সব মিলিয়ে, একজন বাংলাদেশি হিসেবে নিশ্চয়ই আমরা গর্বিত! কিন্তু পুরো দেশের প্রায় ১৮ কোটি জনতার আর্থ-সামাজিক ও মানবাধিকারের কথা ভাবলে কি সত্যিই আমরা গর্বিত হতে পারি?
করোনার ভয়াল থাবায় পুরো দেশ যখন লকডাউনে নিমজ্জিত তখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশু সন্তানরা কেমন ছিল? কোথায় ছিল? প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে যেখানে স্কুলের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল না, ছোট্ট বাড়ি বা বস্তি এলাকায় কেমন কাটতে পারে তাঁদের দৈনন্দিন জীবন? পরবর্তীতে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে বর্তমানেই বা কেমন আছে দেশের কোমলমতি শিশুরা? ইতোমধ্যে মা-বাবার প্রাত্যহিক কাজের সহযোগী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করলেও, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে ও সংসারের সচ্ছলতা আনতে আজ তাঁরা নতুন করে উপার্জনকারী ‘শ্রমিক’ হিসেবে প্রমাণ করছে। আজকাল নতুন করে গৃহকর্মে, ইটের ভাটা, কলকারখানা, হোটেলে, ভ্যানে, এমনকি মাদক-জুয়ার আসরেও তাঁদের শ্রম বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই!    
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। অথচ, আইনের এ বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করে শিশুশ্রম চলছে দেশের আনাচে কানাচে সর্বত্রই! যা শিশু সুরক্ষা তথা শিশু অধিকারের পরিপন্থি! আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার আনন্দে পুলকিত; ঠিক সেই মুহূর্তে শিশু তথা আগামীর ভবিষ্যতের ভয়াবহতার কথা ভাবলে কি আর ভালো থাকা যায়?  
শৈশবে যার হাতে থাকার কথা ছিল বই আর পেন্সিল, যাদের হাত ধরে এদেশ নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তাঁরাই যেন আজ জীবিকায়নের মূল কারিগর হয়ে অভাবগ্রস্ত সংসারের সংগ্রামী সৈনিক সেজেছে! এক শ্রেণির লোভী স্বার্থ পিপাসু মানুষ নামের দানবেরা এসব শিশু ও তাঁর পরিবারের দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে নামমাত্র পারিশ্রমিকে তাঁদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে। কেননা, শুধু বয়সে কম অথবা শিশু হওয়ার জন্যই তাঁদের শ্রমের মূল্য খুবই নগণ্য হয় এ সমাজে! 
পৃথিবীজুড়ে শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক কর্মসূচি গৃহীত হলেও শিশু নির্যাতন তথা শিশু অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি থেমে নেই চোখের সামনেই এমন অজস্র ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই! নির্বাক দর্শক-শ্রোতা হয়ে কেবল হজম করে ফেলি সবকিছু! আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিশু অধিকার সনদে মূলনীতি হিসেবে (১) বৈষম্যহীনতা, (২) শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা, (৩) শিশুর অধিকার সমুন্নত রাখতে অভিভাবকদের দায়িত্ব ও (৪) ‘শিশুদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন’ এর কথা উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশে বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে এর যথাযথ প্রয়োগ খুবই বিরল! মজার ব্যাপার হলো, একই ছাদের নিচে বাড়িওয়ালার শিশু-সন্তানরা যখন ঘুমকাতুরে হয়ে সকাল ১০টায় বিছানা ছেড়ে ওঠে, একই বয়সী গৃহকর্মী নামক আরেকটি শিশুকে তখন কাকভোরে উঠে রুটিনমাফিক ভারী কাজে মনোনিবেশ করতে হয়! নিয়মিত কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হলেও কোনোদিন কোনো বাড়তি প্রশংসা জোটে না। অথচ একদিন ব্যতিক্রমী কিছু ঘটলেই পুরস্কার হিসেবে জোটে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন! আর এসবের সাক্ষী হয় তাঁদেরই সমবয়সী আলালের ঘরে দুলালেরা! তবে কি শিশু অধিকার সনদ কি কেবলই ঐ অভিজাত শ্রেণির বিশেষ শিশুদের জন্যই?   
শিশুশ্রম কেবল একটি শিশু বা তাঁর পরিবারকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে না, বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলে তাঁর সকল সম্ভাবনা! নিষ্পাপ শিশুর শৈশবকে যারা গলা টিপে হত্যা করে বা যারা প্ররোচিত ও বাধ্য করে, তাঁরা কেমন মানুষ! মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হলো সু-শিক্ষা (প্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তবভিত্তিক)। কিন্তু অনুকূল পরিবেশের অভাবে অন্য আরেকটি মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ অন্ন জোগাড় করতে তাঁকে শৈশবেই কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় এ দেশে! কাজ যতই হোক পারিশ্রমিকের বেলায় (অল্প টাকায়) কেবলমাত্র শৈশবকে বিবেচনা করা হয় এ সমাজে!  
সরকার ছাড়াও দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ শিশুশ্রম রোধে নানাবিধ কাজ অব্যাহত রাখলেও শিশুশ্রম কমছে না কিছুতেই! শিশুশ্রম বন্ধের লড়াইয়ে আমরা যেন হারতে বসেছি। নতুন করে করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশে ৩২ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। যা তাঁদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার জন্য ক্ষতিকারক। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বাংলাদেশেও শিশুশ্রম নিরসন দিবস পালিত হলেও আদৌ কি শিশুশ্রম কমেছে এতটুকু? এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘অগ্রগতি স্পষ্ট, কিন্তু আরও কাজ করার আছে : আসুন প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করি!’ তাই সরকারি বেসরকারি ও সামাজিক প্রতষ্ঠানসমূহকে একযোগে সমন্বিত উদ্যাগ নিতে হবে জোরেসোরে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৮.৭-এ বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করার কথা থাকলেও বাস্তবে তার চিত্র ভিন্ন! আর তাই শিশুশ্রমরোধে কাজ করার এখনই তাঁর প্রকৃত সময়! 
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রম নিয়োগ সম্পর্কে যে-মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে মূলত চারটি মাত্রার কথা বলে হয়েছে- সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, যৌথ দর-কষাকষির অধিকার, শিশুশ্রমিকের অনস্তিত্ব ও বৈষম্যহীন নিয়োগ ব্যবস্থা। এগুলো নিশ্চয়ই সব দেশে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এর প্রয়োগকৌশল নিয়ে। দিন, মাস, বছর যায়! সময়ের পরিক্রমায় শিশু দিবস, শিশু অধিকার সপ্তাহ, শিশুশ্রম দিবস, মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। অনেকে আবার শিশুদের উন্নয়নে অনেক কাজ করে, গবেষণা চালিয়ে যায়! বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়! অনেকে আবার দেশবরেণ্য মানুষের স্বীকৃতি পায়! আনেকে নামী-দামী পুরস্কারও পায়! কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি আমজনতার শিশুদের অধিকার কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয় না! বন্ধ হয় না শিশুশ্রম!
শিশুশ্রম ও শিশু অধিকারের বিষয়টি আমাদের মনে নিশ্চয়ই অনেক বেশি নাড়া দেয়! বাস্তবতা হলো- সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে শিশুশ্রম কমবে না। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সুন্দর আগামীর জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি প্রয়োজন, প্রতিটি শিশুর জন্য আমজনতার আন্তরিক ভালোবাসা! নয়তো, এই শিশুরাই আগামীতে গর্বিত নাগরিক না হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, মাদকসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে যাবে! বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী দেশে ‘বাড়ছে শিশুশ্রম, বঞ্চিত হচ্ছে শিশু অধিকার’! তবুও যে কোনো সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই চাইবেন শিশুশ্রম বন্ধ হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক শিশু অধিকার! 
লেখক : কো-অর্ডিনেটর, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড সোশ্যাল একাউন্টিবিলিটি, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
[email protected]

প্যানেল

×