ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

ইলিশে মাইক্রোপ্লাস্টিক

প্রকাশিত: ১৭:৪০, ১৮ জুন ২০২৫

ইলিশে মাইক্রোপ্লাস্টিক

বর্তমানে প্রায় সর্বত্র দূষণ কবলিত বিশ্বে যে কয়েকটি পদার্থের নাম সর্বাগ্রে উঠে আসে সেগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে প্লাস্টিক। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য প্রায় প্রতিটি পণ্যে প্লাস্টিকের উপস্থিতি বলা যায় অপরিহার্য। এটি একটি অপচনশীল পদার্থ, যা সহজে মিশে যায় না প্রকৃতি ও পরিবেশে। বরং এটি প্রবল দূষণ সৃষ্টিকারী অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় বিভক্ত হয়ে মিশে থাকে জলাশয়ে, খাদ্যদ্রব্যে এমনকি মানবদেহের মস্তিষ্কে পর্যন্ত। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, মানুষের সর্বাধিক স্পর্শকাতর অংশ মস্তিষ্কের মধ্যেও পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা, যা এক কথায় অশনি সংকেত। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, গঙ্গা নদী এবং এর উপনদীগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন একশ’ থেকে তিনশ’ কোটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা গিয়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। উপকূলীয় অঞ্চলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আধিক্য মাছ ধরার নৌকা পণ্যবাহী জাহাজ ও গৃহস্থালি বর্জ্য নিষ্কাশনের মাধ্যমে সম্পর্কযুক্ত এসব এলাকায় ধৃত মাছও বাধ্য হয়ে গ্রহণ করে থাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা গ্রহণ করা হয় খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে।
এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে মেঘনার মোহনায়ও। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ গভীর জলের মাছ হলেও নদী মুখে ধৃত ইলিশের শরীরেও বাসা বেঁধেছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা, যা রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো। ইলিশের শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যাডমিমাম, সীসা, পারদ ও আর্সেনিকের মতো মানবদেহের জন্য সমূহ ক্ষতিকর ভারী ধাতু। গবেষণায় পাওয়া গেছে, ইলিশের অন্ত্রে, যকৃতে এমনকি পেশিতেও পাওয়া গেছে ৫ মিলিলিটারের চেয়েও ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা। এসব কণা প্লাস্টিক ব্যাগ, বোতল, সিনথেটিক কাপড়, টায়ার কিংবা কসমেটিকের মাধ্যমে নির্গত হয় পানি ও জলাশয়, যা গিয়ে মিশে সাগরে। ইলিশসহ অন্যান্য মাছ এসব গিলে খেয়ে থাকে। গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ওয়াটার এয়ার সয়েল পলিয়েশনে। এটি পরিচালনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের একদল বিজ্ঞানী। ইলিশের দেহে প্রাপ্ত মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা মানবদেহের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা বিস্তারিত জানা না গেলেও সুস্বাদু ও রসনালোভন ইলিশের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার উপস্থিতি গভীর উদ্বেগের বিষয়।
জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ইলিশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসে ইলিশ থেকে। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যতিরেকে অন্য ১০টি দেশেই কমেছে ইলিশের উৎপাদন। একমাত্র বাংলাদেশেই প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে ৯-১০ শতাংশ হারে। বিশ্বের ৬৫ শতাংশ ইলিশের জন্ম হয় বাংলাদেশে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে পাওয়া যেত ইলিশ। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদী-নদীতে সন্ধান মিলেছে ইলিশের। দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১১ ভাগই ইলিশ। উপকূলীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের প্রায় পাঁচ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি জড়িত। এছাড়া ২০-৯৫ লাখ লোক জড়িত পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কাজে। সর্বস্তরের মানুষ যদি জাতীয় একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পণ্য ইলিশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতন হয় তাহলেই এর উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দূষণরোধ নিশ্চিত করা সম্ভব।

প্যানেল

×