
দেশের নৌনিরাপত্তায় রাতের আঁধারে নদীতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। তারপরও রাতের আঁধারে বাল্কহেড-স্পিডবোটের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রায়ই হতাহতের খবর পাওয়া যায়। কেন এই আইন লঙ্ঘন? নিরাপত্তার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নৌপুলিশ রয়েছে। আছে কোস্টগার্ডের সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশে পরিবহন খাতে নৈরাজ্য অতি পুরনো সংস্কৃতি। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল যেন শেষই হচ্ছে না। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সিংহভাগই প্রান্তিক সমাজের সদস্য। দেশের অভ্যন্তরীণ ভৌগোলিক সীমায় সুবিস্তৃত নৌপথ রয়েছে। যার জনবহুল ব্যবহারযোগ্য পথগুলোই অনিরাপদ। মেঘনার দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা ও তীরবর্তী পাশ্বাঞ্চলে বালুবাহী ঝুঁকিপূর্ণ বাল্কহেডগুলো দিন ও রাতে চলাচল করে। এ নৌপথ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের প্রকৃতি প্রদত্ত সংযোগ সৃষ্টি করেছে। দেশটির তিনটি সমুদ্রবন্দর থেকে পণ্য খালাস করে এ নৌপথ দিয়ে ঢাকা ও পাশ্ববর্তী শিল্পাঞ্চলগুলোতে পণ্য পৌঁছানো হয় খুব কম খরচে। জনবহুল বাংলাদেশে যুবশক্তির কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে আশির দশকের মাঝামাঝি রাজধানীর ভৌগোলিক সীমালাগোয়া বিস্তৃত অঞ্চলে শিল্প-কলকারখানা তৈরি হতে থাকে। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গী, গাজীপুর সিঙ্গাইর ও সাভারের নিম্নাঞ্চলে বালু ভরাটের প্রয়োজন দেখা দেয়।
রাজধানীর পাশ্ববর্তী নিম্ন জলাভূমি ভরাটে প্রয়োজন দেখা দেয় প্রচুর বালির। যার প্রধান উৎস বিস্তীর্ণ মেঘনার বিশাল জলরাশির তলদেশ। বালু পরিবহনে গড়ে বেআইনী সিন্ডিকেটের বাল্কহেড চক্র। যারা রাষ্ট্রের আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন ও পরিবহনে প্রত্যক্ষভাগে যুক্ত। নৌপথে দ্রুত যাত্রী পরিবহনে লঞ্চ ও স্পিডবোট একটি জনপ্রিয় বাহন। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি, তা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। রাতের আঁধারে স্পিডবোট চালানো নিষেধ। তবু চলছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে। বাংলাদেশে সরকারি দপ্তরগুলোর তথাকথিত ম্যানেজ সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে নাগরিক জীবনে চলার পথে স্থিতি ও সুস্থতা প্রতিষ্ঠা করানোই সম্ভব নয়। দেশের প্রধান অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর সদরঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলগামী লঞ্চগুলোর প্রধান যাত্রাপথ বুড়িগঙ্গা, ধলেশ^রী, মেঘনা ও পদ্মা নদী। উত্তরাঞ্চলগামী তেলবাহী জাহাজগুলোর যাতায়াত মুন্সীগঞ্জ লাগোয়া পদ্মার উজানে। এমন ব্যস্ততাপূর্ণ নৌপথে দিন-রাত বাল্কহেডের যত্রতত্র ও বিক্ষিপ্ত যাতায়াত যাত্রীবাহী লঞ্চ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি নৌপরিবহনকে প্রচণ্ড রকম ঝুঁকিতে ফেলেছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে গত সাড়ে ৫ বছরে সড়ক, রেল ও বিস্তীর্ণ নৌপথে ৩২৭৩৩টি দুর্ঘটনায় ৩৫৩৮৪ জন নিহত এবং ৫৩১৯৬ জন আহত হয়েছেন। যার অর্থনৈতিক ক্ষতি ৮৭ হাজার ৮৮৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ সময়ের মধ্যে ৫৮৭টি নৌদুর্ঘটনায় ১০২১ জন নিহত ও ৩৬৯ জন নিখোঁজ এবং আহত হন ৫৮২ জন। এই পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। যোগাযোগ ব্যবস্থায় মৃত্যুর মিছিল কোনোভাবেই কাম্য নয়। শক্তিশালী নৌনিরাপত্তা ব্যবস্থা গঠন, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমেই অযুত সম্ভাবনাময় নৌপথের আরামদায়ক নিরাপদ ভ্রমণ ও পরিবহন সুনিশ্চিত করতে হবে জাতীয় স্বার্থে।