ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

শুভ বড়দিন

মিলন ও মেলাবার উৎসব

জাসিন্তা আরেং

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

মিলন ও মেলাবার উৎসব

যিশুখ্রিস্টের জন্মতিথি বা বড়দিন

যিশুখ্রিস্টের জন্মতিথি বা বড়দিন হলো আত্মিক মিলনের সুপ্রকাশ ঘটানোর দিন। খ্রিস্ট জন্মের এই আনন্দকে সহভাগিতার উদ্দেশে বিশ্বাসীরা পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধনে মিলিত হন ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে। দীর্ঘ ২০২৪ বছর ধরে নদীর মতোই প্রবহমান এই খ্রিস্টবিশ্বাসের চেতনায় মিলনান্দের তীর্থ অনুষ্ঠিত হচ্ছে খ্রিস্ট জন্মোৎসবকে ঘিরে।

এই উৎসবের সঙ্গে মানব জীবনের এক গভীর সংযোগ রয়েছে, যা মিলনের সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই পূর্ণতা লাভ করে। ধনী-গরিবের বিভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিলনের মধ্য দিয়েই মানুষের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে এবং একতার মিলন সমাজ গড়ে তুলতে প্রত্যয়ী হয়। এই উৎসব সর্বজনীন ও সাম্যের মিলনকেই অনুপ্রাণিত করে। কাজেই, বড়দিন হলো ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে পরস্পরের সঙ্গে মেলার ও মেলাবার উৎসব ও আহ্বান। আবহমানকাল থেকে চলে আসা সেই আহ্বানকে নবায়নের দিনটিই হলো বড়দিন।
যিশুখ্রিস্ট এই ধূলির মর্তে আগমন করেছিলেন মানুষের সঙ্গে মিলন ও একাত্মতার উদ্দেশ্যে। খ্রিস্টের জন্মতিথি বিশ^াসীদের মর্তলোকে সকলের সঙ্গে একাত্মতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। খ্রিস্টান সমাজে বাস্তব জীবনে এই মিলন আহ্বানে সাড়া দেওয়ার ব্যাকুলতা দেখা যায় খ্রিস্টের জন্মতিথি ঘনিয়ে এলে। বড়দিন উৎসবকে কেন্দ্র করে কর্মজীবীরা নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে গ্রামের বাড়িতে ছুটে আসেন প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলনের প্রত্যাশায়।

অনেকেই সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে বিদেশ থেকে দেশে আসেন মিলনের আমন্ত্রণে। যা বড়দিনের আনন্দ সহভাগিতাকে আরও অর্থপূর্ণ করে তোলে। যেভাবে এই মিলনের উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে, তা শতাব্দীর পর শতাব্দী চলমান থাকুক- সেটাই প্রত্যাশিত। আমাদের দেশে পরস্পরের সঙ্গে মেলার ও মেলাবার এই চিরন্তন আকাক্সক্ষা ও আনন্দকে জিইয়ে রাখতে হবে। কারণ, পরস্পরের সঙ্গে মিলনেই প্রকাশ পায় স্বর্গীয় একাত্মতা। 
বর্তমানে এই যান্ত্রিক সমাজে আন্তঃম-লীক সুসম্পর্কের নিতান্তই অভাব। খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টান, ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক যে কোনো সম্পর্কই নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যতিবস্ত। বিশেষ করে, শহরে বসবাসরত মানুষদের প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়ার সময় ও সুযোগটুকুও হয়ে ওঠে না। আজকাল এভাবেই প্রতিযোগিতাপূর্ণ শহুরে সমাজে সম্পর্কগুলো ঠুনকো এবং শীতলপ্রায় হয়ে পড়ছে। প্রতিনিয়ত নিজের আবেগ-বিবেককে জলাঞ্জলি দিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মানুষ। একে অপরের কল্যাণে কাজ করার বাসনা যেন হারিয়ে ফেলেছে।

অজান্তেই গ্রামীণ জীবনেও সম্পর্কগুলো হাল্কা হতে শুরু করেছে। একই পাড়া বা মহল্লায় বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও একে অপরের সঙ্গে ওঠা-বসা নেই। কোনো উৎসব কিংবা আয়োজনে নিমন্ত্রণ ও আমন্ত্রণ নেই। জাতীয় কিংবা ধর্মীয় এবং ব্যক্তিগত কোনো অনুষ্ঠানে যোগাযোগ নেই। বিবাদ, বিরোধ ও যথাযথ যোগাযোগের অভাবে সম্পর্কে দূরত্ব স্থান করে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়াও প্রতিকূল পরিস্থিতি, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নানাবিধ কারণেই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কগুলো দ্বন্দ্ব ও বিষাদময় হচ্ছে। আমাদের উচিত স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে মিলন বন্ধন গড়ে তোলার বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করা। বড়দিনের এই মাহেন্দ্রক্ষণ স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মিলনেই প্রকৃত আনন্দ এবং একাকিত্বে নিরানন্দ।

মিলনের মধ্য দিয়েই সম্পর্কগুলো গভীর, আনন্দময়, প্রতিবেশীসুলভ এবং আন্তরিক হয়। সুতরাং সকল বিরোধ, দ্বন্দ্ব, বিভাজন ও বৈষম্যের অন্ধকারকে দূরে ঠেলে মিলনসমাজ গঠন করতে সকল সুনাগরিকই আহূত। তা ছাড়া, বৈষম্যময় পরিবেশে লড়াই করে বাঁচতে হলেও সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ও মিলনের সম্পর্ক গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।      
বড়দিন হলো মহামিলনের চিহ্নস্বরূপ। আত্মিক নবায়ন এবং ক্ষমাদান ও ক্ষমালাভের মধ্য দিয়ে মেলার ও মেলাবার এই আয়োজন সকলের জন্য নিবেদিত। মিলন ও ভ্রাতৃত্ববোধকে সবার শীর্ষে রেখে সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। একক প্রচেষ্টায় কখনই বৃহত্তর স্বার্থ উদ্ধার করা সম্ভব নয়। তাই সামাজিক মিলন বন্ধন দৃঢ়করণে প্রত্যেকেরই একে অপরের ধর্মীয় রীতি-নীতির প্রতি সম্মান রেখে মিলন ও সম্প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বড়দিন উৎসব সামাজিক মিলন উৎসবে রূপান্তরিত হতে পারে।

তবে একে অপরের উৎসবের আনন্দ সহভাগিতা করার মতো উদার মনমানসিকতা তৈরি করতে হবে। প্রসঙ্গত, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘যে কোনো উপলক্ষে হোক, অনেক লোকের চিত্ত এক হতে পারলে; তাতে মহৎ ফল ফলে।’ বড়দিন উৎসবের আনন্দ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মাঝে সহভাগিতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠুক এক ও অভিন্ন মিলনসমাজ। মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধন অবিচ্ছেদ্য ও অটুট হোক, তুচ্ছ কারণে তা বিছিন্ন হয়ে না পড়ুক সেটাই কাম্য। 
বড়দিন মানেই সামাজিক মিলনের আরেক নাম। যিশুখ্রিস্ট মানববেশে জন্মেছেন ঈশ^রের সঙ্গে মানুষের ও মানুষের সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন রচনা করতে। একইভাবে আমাদেরও উচিত পরস্পরের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতে উদারতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন এবং একে অপরের আনন্দ উৎসবের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা। খ্রিস্টের জন্মতিথি প্রতিবছরই আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোকে পুনরায় মূল্যায়ন ও নবায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে।

খ্রিস্ট জন্মোৎসবের আনন্দ নিজ পরিবার কিংবা নিজ ধর্মাবলম্বীর মাঝে সীমিত রাখা মিলন উৎসবের অন্তরায়। আজকাল অনেকেই ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরে উৎসবের আনন্দ সহভাগিতা করতে কৃপণতা করে, যা দেশীয় সংস্কৃতির মর্যাদাকে ক্ষুণœ করছে। ঝগড়া-বিবাদ, বিরোধ ও পারস্পরিক তিক্ততার কথা ভুলে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে পুনর্মিলিত হওয়াই বড়দিনের প্রকৃত শিক্ষা। এই আনন্দে শরিক হতে সকলকে উদ্বুদ্ধ করাও আমাদের নৈতিকতার অংশ। 
সহভাগিতা যেন বড়দিন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেকালে এই উৎসবকে ঘিরে ঘটা করে নানা রকম পিঠাপুলি ও পায়েস বানানো হতো এবং প্রতিবেশীদের সহভাগিতা করে খাওয়া হতো। যাদের নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠাপুলি বানানো কিংবা নতুন জামা-কাপড় কেনার সামর্থ্য ছিল না; তাদের প্রতিও আন্তরিকতার কমতি থাকত না। পরস্পরকে সহযোগিতা ও সহভাগিতার মাধ্যমে বড়দিনের আনন্দ ও ভালোবাসায় উভয়পক্ষের হৃদয় আন্দোলিত হতো। সেই সঙ্গে, সম্পর্কে ফাটল থাকলেও তা অচিরেই ভুলে যেত এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত আরও মজবুত হতো।

কিন্তু বিশ্বায়নের প্রভাবে এই সংস্কৃতির চর্চা এখন প্রায় হারাতে বসেছে। আনন্দ সহভাগিতা ও সহানুভূতি যেন এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সীমিত। অন্যদিকে, বর্তমানে অর্থনীতির চাকা বদলে যাওয়ায় অনেকেই আনন্দ সহভাগিতায় কৃপণতা করে থাকে। ফলে, সেকালের মতো সহভাগিতার আনন্দ উপলব্ধি করতে পারে না। সহভাগিতা ও ভালোবাসায় আন্তরিকতার অভাব থাকলে মিলনের এই আহ্বান কখনই পরিপূর্ণতা লাভ করে না। 
বড়দিন হলো সকলের সঙ্গে মেলার ও মেলাবার মহোৎসব। কাজেই, এই মিলনানন্দ থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়, তা খেয়াল রাখাও আমাদেরই দায়িত্ব। বড়দিনকে কেন্দ্র করে এই মহামিলনের সুরধারা সমাজের গ্লানি, হতাশা, বিরোধ-বিভেদ, বৈষম্য ও অন্ধকারময় জীবনের অবসান ঘটিয়ে একতা, মিলন ও আনন্দের প্রকাশ ঘটাবে, এটাই প্রত্যাশা।

যিশুখ্রিস্ট যেভাবে নিজ ঈশ^রত্বকে ধুলায় নামিয়ে নম্রতা, প্রাকৃতিক ভালোবাসা ও নির্মলতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, একইভাবে সেই কৃত্রিমতা বর্জন করে প্রাকৃতিক ভালোবাসা ও ন¤্রতার প্রকাশ ঘটুক আমাদের আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে। বড়দিন উৎসবের এই নির্মল আনন্দকে সবার সঙ্গে সমানভাবে সহভাগিতার মধ্য দিয়ে আরও খাঁটি ও মধুময় করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত থাকুক। মেলার ও মেলাবার এই উৎসব উত্তরোত্তর উদ্যাপিত হোক নিরবধিকাল। 
লেখক : সাংবাদিক

[email protected]

×