ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৬ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি’ এখনও প্রাসঙ্গিক

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২২ মে ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি’ এখনও প্রাসঙ্গিক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রাপ্তির দিন আজ। সেটিও  জাতির পিতা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত দিয়ে। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে গিয়েছিলেন এ প্রাপ্তির আরও বছর পাঁচেক আগেই, ১৯৬৯ সালে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে করেছে জাতির পিতা, বাঙালির ‘অবিসংবাদিত নেতা’। বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় ১৪০টি দেশের প্রায় ২০০ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

তারা সবাই একমত হয়েছিলেন, সারা জীবনের দর্শন আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কত্বের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক দেওয়ার জন্য। সেই বিবেচনায় স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর এ পদকের জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করে।

শান্তি পরিষদের ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের মে মাসে এশিয়ান পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্ব শান্তি পরিষদের দুদিনের সম্মেলন হয় ঢাকায়। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বসে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল মিলনমেলা।

অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে বঙ্গবন্ধুকে পদকটি পরিয়ে দেন বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশচন্দ্র। আড়ম্বরপূর্ণ ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে এ পদক পরিয়ে দেওয়ার অনুষ্ঠানে রমেশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু।’

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারীদের এ পদকভূষিত করা শুরু হয় ১৯৫০ সাল থেকে। বাংলায় ‘জুলিও কুরি’ বলা হলেও এর ফরাসি উচ্চারণ ‘জোলিও কুরি’। ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাদের শান্তি পদকের নাম ১৯৫৯ সাল থেকে রাখে ‘জোলিও কুরি’।

ফ্রেডেরিকের মূল নাম ছিল জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও। ফ্রেডেরিকের স্ত্রী ইরেন কুরি। তিনিও বিজ্ঞানী। বিয়ের পর ফ্রেডেরিক ও ইরেন উভয়ে উভয়ের পদবি গ্রহণ করেন এবং একজনের নাম হয় জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি এবং অন্যজনের নাম ইরেন জোলিও কুরি। রেডিওলজির ওপর উইলিয়াম রঞ্জেনের আবিষ্কারের পথ ধরে কুরি দম্পতি তাঁদের গবেষণা চালিয়ে যান এবং পলোনিয়াম ও রেডিয়ামের মৌল উদ্ভাবন করেন।

তাঁদের উদ্ভাবন পৃথিবীতে পদার্থবিদ্যায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। পরে যৌথভাবে তাঁরা নোবেলও পান। ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি দম্পতির জীবনও বৈচিত্র্যময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি শুধু বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেননি। গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন। তাদের জন্য হাতিয়ারও তৈরি করেন। তাঁর অবদানের সুবাদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান  সহজ হয়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধটির পরিসমাপ্তি ছিল জরুরি। তিনি নিজে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভাপতিও ছিলেন। 
ইন্দিরা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুসহ আরও অনেকে জুলিও কুরি পদক পেয়েছেন। ফিদেল ক্যাস্ত্রো, সালভেদর আঁলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিং, লিওনিদ ব্রেজনেভ, ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের সংগ্রামী নেতা হো চি মিন তো আছেনই। কিন্তু, বঙ্গবন্ধুর প্রেক্ষিত ও বিষয়টি একটু ভিন্ন।

কেবল নিজ দেশে নয়, বিশ্বের দেশে দেশে শান্তির আকাক্ষা ছিল তাঁর।  রাজনীতিতে শান্তি আর বঙ্গবন্ধু অনেকটা একাকার। যুদ্ধ নয়, শান্তি। কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, বন্ধুত্ব- এই সবক তাঁরই দেওয়া। বঙ্গবন্ধুকে ওই পদক ভূষিত করার বিবেচনা ও মানদ- ছিল তাঁর শান্তি চর্চার দর্শন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কত্বের প্রেক্ষাপট। আর বঙ্গবন্ধুকে শান্তির পদকে ভূষিত করার নেপথ্যে বিবেচনায় বটম লাইন ধরা হয়েছে ছাত্রাবস্থা থেকেই শান্তিকামনার মানসিকতাকে।

পরে রাজনীতির মাঠে যোগ হয়েছে অহিংস তথা শান্তির মাধ্যমে সামনে এগোবার নানা ঘটনা। তা ছিল তাঁর কূটনীতিতেও। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কারাভোগের পর ৫২ সালের অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত ‘পিস কনফারেন্স অব দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’ সম্মেলনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন কিছুটা অসুস্থ শরীরে।  সেখানে ৪০টির মতো দেশের  শান্তিকামী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাঁর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বে অভিভূত হন তারা।

এর বছর চারেক পর ১৯৫৬ সালের ৫-৯ এপ্রিল স্টকহোমে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনেও অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। শান্তি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব শান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
আজ বিশ্বময় পরাশক্তিগুলোর তৈরি স্নায়ুযুদ্ধের এ সন্ধিক্ষণেও শান্তির সেই ডাক নেই। তাই বঙ্গবন্ধু আজকের বিশ্বেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সেখানে বঙ্গবন্ধু স্মরণে চলে আসেন আপনাআপনি-অবচেতনে। গোটা জীবনে অবিরাম অশান্তি দেখেছেন, সয়েছেনও। ট্র্যাজেডি হচ্ছে, শান্তির বিশ্ব দেখার এই মহাপ্রত্যয়ী শান্তি দেখে যেতে পারেননি। তা তাঁর হাতে গড়া দেশেও।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়া স্বাধীন দেশে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় এই শান্তিকামীর। নিজ জীবনে একটি বিশ্বযুদ্ধ (দ্বিতীয়) দেখেছেন বঙ্গবন্ধু। এর প্রতিক্রিয়াও প্রত্যক্ষ করেছেন। সে সময় তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুস্থ ও অনাহারীদের কাছে ছুটে গেছেন খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়টিতে বিশ্ব পরিস্থিতি, শান্তি, প্রগতি, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো এবং গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অনুকূলে পরিবর্তিত হয়েছিল।

এ সময় উপমহাদেশে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ভেতর সৎ প্রতিবেশীমূলক সম্পর্ক স্থাপন এবং উপমহাদেশে শান্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭১ এবং বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭২, বাংলাদেশের মৈত্রী-সম্পর্কে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি স্থাপনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। 
বিশ্বরাজনীতিতে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ব্লকের মোড়লিপনার লড়াই। ছিল সামরিক জোটও। বিশ্বশান্তি কামনার প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে কোনো সামরিক জোটে নেননি। তাঁর স্পষ্ট কথা ছিল, আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী। বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব প্রত্যাশী।

বিশ্বের যেই প্রান্তের যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, অশান্তি ভর করেছে- এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।  দিয়েছেন শান্তিবার্তা। তৎকালীন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনিসহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন।

বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানবকল্যাণের যেকোনো মহৎ প্রচেষ্টার সাফল্য কামনা করে ক্ষোভ জানিয়েছেন অন্যায়ভাবে আরব এলাকা ইসরাইলের জোরপূর্বক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে। দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল বর্ণভেদবাদী নীতির। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের বার্তাগুলো আজও কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, শান্তি-সম্প্রীতির বীজমন্ত্রও।
আজকের যুদ্ধবাজ দেশগুলোর প্রতি বঙ্গবন্ধুর সেই শান্তির আহ্বানের প্রতিধ্বনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠেও। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্বে অস্থিরতায় ঊষ্মা প্রকাশ তিনি করেই যাচ্ছেন। ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অশান্তির প্রতিবাদেও তিনি সোচ্চার।

যুদ্ধের পেছনে অর্থ ব্যয় না করে জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জের রোখার পেছনে ব্যয় করলে বিশ্ব প্রাকৃতিকভাবে শান্তিময় হবে- এই আহ্বান তিনি বিশ্বনেতাদের প্রতি রেখেই চলেছেন। রোহিঙ্গাদের ঠেলে পাঠানোসহ বাংলাদেশের পায়ে পা দিয়ে মিয়ানমারের গ-গোল পাকানোর নানা ফন্দির জবাবে তিনি বিশ্বসম্প্রদায়কে উদ্দেশ করে বারবার জানান দিচ্ছেন, বাংলাদেশ কোনো সংঘাত চায় না। এও জানতে চেয়েছেন, ‘এখন কেন বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছে?

অস্ত্র প্রতিযোগিতায় যে অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে তা কি ক্ষুধার্ত শিশু ও মানবকল্যাণে ব্যবহার করা হতে পারে না?’ ফিলিস্তিনের গাজা, ইরান-ইসরাইল উত্তেজনাসহ মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে চলমান অশান্তির বিষয়ে মতপ্রকাশ ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরব। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় পরিস্থিতি বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অশান্তিতে পড়তে পারে বলে সতর্ক থাকতে বলছেন।

এ পরিস্থিতিতে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান ঘটনাগুলোর দিকে নজর রাখার নির্দেশও দিয়েছেন। তাঁর এসব পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনার পরতে পরতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর শান্তির বার্তা ও কৌশলের ব্যাপক ছাপ। 

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

×