ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৬ জুন ২০২৪, ২ আষাঢ় ১৪৩১

দুটি ব্যতিক্রমী বই

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২২ মে ২০২৪

দুটি ব্যতিক্রমী বই

দুটি ব্যতিক্রমী বই

২০২৪ সালের এপ্রিলে আমি যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনে ছিলাম। সেখানে থাকাকালীন এ বছরে প্রকাশিত দুটি ব্যতিক্রমী বই পড়ার সুযোগ হয়েছিল। এর একটি হলো Byron Tau লিখিত ও ক্রাউন প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত Means of Control : Hwo the Hidden Alliance of Tech and Government is Creating a Nwe American Surveillance State.আর দ্বিতীয়টি  হলো হার্ভার্ড প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত গরহীরহ চবর লিখিত The Sentinel State : Surveillance and the Survival of Dictatorship in China.
চীনের একনায়কতত্ত্বের ওপর লেখা বইটির লেখক মিনস্কিন পেই চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর খ্যাতনামা গবেষক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রস্থ ক্লেয়ারমন্ট মেকক্যানা কলেজে শিক্ষকতা করেন। এই বইয়ে তিনি ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েনানমিয়েন চত্বরে ঘটা রাজনৈতিক বিদ্রোহের পর চীন সরকার কিভাবে ও পরিমাণে জনগণের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে তার বিবরণ ও বিশ্লেষণ দিয়েছেন।

একনায়কত্ব ভিত্তিক সরকার বা শাসনে অর্থনৈতিক প্রগতি ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে উদার করে তুলে বলে এরূপ শাসন ও প্রক্রিয়ার কতিপয় পর্যবেক্ষক আগে মত দিয়েছেন। পিইর মতে, চীনে এই ধরনের পরিবর্তন ঘটেনি। পিই ১৯৮৯-এর তিয়েনানমিয়েনের সামাজিক অভ্যুত্থান বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ঐ ধরনের বিদ্রোহ যেন আর না ঘটে, সেজন্য চীন সরকার চীনা জনগণের ওপর তার গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়ে চলেছে।

কয়েক যুগ আগে থেকেই চীন রাষ্ট্রের তরফ হতে গোয়েন্দা তৎপরতা বিস্তৃত করে আসছে। ফলত, চীনে সরকারি গোয়েন্দা তৎপরতা ক্রমান্বয়ে বিতরিত বা বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে শুরু করে কোলাহল মুখর নগরীতে কেন্দ্রীয় সরকারের গুপ্তচরবৃন্দ ব্যাপকভাবে কাজ করছে। একই সূত্র অনুসরণ করে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতিজনের সকল ব্যক্তিগত তথ্য- তাৎক্ষণিকভাবে কেউ বা কোনো কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করবে কিনা- তা বিবেচনায় না নিয়ে চীনের সমাজ প্রশাসনে প্রতিনিয়ত আহরিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে।

চীনের সাম্প্রতিক সমৃদ্ধির পটে এই প্রক্রিয়া বিস্তৃত ও অধিকতর জোরদার করার জন্য চীনা কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে। লেখকের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, স্থানীয় ও আঞ্চলিক পুলিশ বাহিনীতে গুপ্ত তথ্য আহরণের সক্ষমতা নিরবচ্ছিন্নভাবে চীন সরকার বাড়িয়ে চলছে। ফলত, চীনের সমাজে প্রতিবাদ শুরু হওয়ার আগেই কর্তৃপক্ষ তা দমন বা ভিন্নপথে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়েছে।

পেইর মতে, ২০২৪ সালে হংকংয়ে যে দৃঢ় বিপ্লবের অবতারণা হয়েছিল, তা চীনের অন্যকোনো এলাকায় ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। চীনে জাতীয় ও আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজন গুরুত্বপূর্ণ সকল ব্যক্তির ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। উদাহরণত, এভাবেই চীন উইঘর মুসলিম ও ফালুনগংয়ের মতো ধর্মীয় সংগঠনকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দিচ্ছে না।

পেইর হিসাব মতে, চীন সরকার জনসংখ্যার প্রায় ১% এরূপ সরকারের নজরদারির আওতাভুক্ত রেখে সরকারের প্রতিকূলে সম্ভাব্য আন্দোলন কিংবা তৎপরতা নিরোধ করতে সফল হয়েছে। সেদেশে একপ্রকার সামাজিক ঋণের বা জবাবদিহির ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে, যা প্রশাসিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে প্রতি নাগরিকের জন্য আনুগত্যর বা নির্দেশ পালনের আমলনামা প্রযোজিত হচ্ছে।

এই আমলনামায় ভুক্তির আলোকে প্রকারান্তরে নাগরিকদের জন্য চাকরি, অবকাশ, ভ্রমণ, এমনকি রেস্টুরেন্টে প্রবেশাধিকার পর্যন্ত বরাদ্দ করা হয়ে থাকে।    
বায়রন টাও বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার বেসরকারি কোম্পানিসমূহের সঙ্গে কার্যকরণ ভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপন করে নাগরিকদের সম্পর্কে তাদের জানার বাইরে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত আহরণ করে থাকে। ফোন ও কম্পিউটার কোম্পানিসমূহ এসবের ব্যবহারকারীদের থেকে জেনে নেয় তারা কোত্থেকে এসেছেন, কাদেরকে চেনেন এবং কিসে বিশ্বাস করেন।

টাও দেখিয়েছেন যে, গাড়ির টায়ারও এক্ষেত্রে রেডিও সিগন্যাল দিয়ে থাকে, যা যে কোনো ব্যক্তি এন্টেনা লাগিয়ে কিংবা তার সহায়তায় গাড়ির মালিক বা চালকের অবস্থান ও গতিবিধি জানতে পারেন। এসব তথ্য আহরণ করে সরকারি সংস্থাসমূহ অনেকক্ষেত্রে বেআইনিভাবে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি জেনে তাদের ব্যক্তিগত বা স্বাধীন পারিপাশির্^কতায় হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম।

উদাহরণত, সাধারণভাবে নগর বিশেষের চলাচলের বিষয়ে লভ্য তথ্যাদি অটোনমরের মতো কোম্পানি, উবার মেডিয়া বা ভেনটেল হতে জনগণের ভোগ বা ব্যবহার সংক্রান্ত উপাত্তাদি কিংবা ইন্টারনেটভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান হাজারো ভিন্নতর ব্যবহারে সক্ষম বা পারদর্শী বিপণি সংস্থাকে সরবরাহ করতে পারে।

এর ফলে, ব্যক্তির উপাত্তাদি প্রাথমিক ব্যবহারকারীর অজ্ঞাতে যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে লভ্য বা ব্যবহারযোগ্য হয়ে যায়। এসব তথ্য ও উপাত্তাদি দ্রব্য এবং সেবা সামগ্রী বিক্রয় এবং আইন প্রয়োগ করতে ব্যবহৃত হয় বা হতে পারে। টাও বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা জানেন না কখন এবং কিভাবে তাদের এসব উপাত্তাদি সরকার প্রযুক্তি কোম্পানি ও সংস্থা থেকে সংগ্রহ করে তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ক্রমাগতভাবে সীমিত করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশেও আমরা অনেকটা অজান্তে ও অর্বাচীনের মতো সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যাদি আহরণ করেছি। উদাহরণত, সরকারি চাকরি পেতে হলে প্রার্থীকে পুলিশের কাছে যে তথ্য দিতে হয়, তাতে তিনি কোন্ রাজনৈতিক দলের সমর্থক তাও অন্তর্ভুক্ত। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এরূপ তথ্য আহরণীয় কিংবা ব্যবহার যোগ্য নয়।

রোগ নির্ণয়, চিকিৎসার ধরন বা সংশ্লিষ্টতা, ব্যবসায়ের লাইসেন্স নেওয়া, জমি বা সম্পত্তি হস্তান্তরের প্রক্রিয়া, কর প্রদান প্রভৃতি পদচারণায় সরকার কর্তৃক সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যের বাইরে তথ্যাদি আহরণ করা হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতির জনকের ওপর গোয়েন্দা তৎপরতার বিবরণে দেখা যায় যে, পাকিস্তান সরকার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মীর কাজ ও চলাফেরার ওপর কি ধরনের নজরদারি আরোপ করেছিল।

এরূপ মুক্ত জীবনের প্রতিকূলের সরকারি তৎপরতা এখনও যে চলছে বা আরোপিত হচ্ছে না, তা নিশ্চিতভাবে বলা চলে না। বিবাহ সম্পাদন ও বিচ্ছেদ, আইন আদালত থেকে জামিন নেওয়ার প্রক্রিয়া, ছাড়পত্রের দরখাস্ত উপস্থাপন, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যের বাইরে তথ্যাদি চাওয়া ও দেওয়া হয়।

সম্প্রতি এও বিদিত হয়েছে যে, সরকারের অসাধু কর্মচারীরা ৭৮৯ সংস্থা বা দলের কাছে জাতীয় উপাত্ত কেন্দ্র থেকে ব্যক্তি পর্যায়ের তথ্য বিক্রি করে থাকে (দ্রষ্টব্য: ডেইলি স্টার, মে ২১, ২০২৪)। এই সকল ক্ষেত্রে সংসদ ও সরকারের তরফ থেকে কার্যকরণের প্রয়োজনের বাইরে তথ্য আহরণ ও ব্যবহারে সাবধান হয়ে এবং স্বাধীনসত্তা বিকাশ ও সংরক্ষণে দায়িত্বাদি মনে করে আমাদের এগোতে হবে।

সংবিধানে প্রদত্ত আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী এবং একমাত্র আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভের নিশ্চয়তা (অনুচ্ছেদ-৩১), আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে কাউকে বঞ্চিত না করার বিধান (অনুচ্ছেদ-৩২) এবং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রকৃতির ভিত্তিতে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তাকরণে প্রতিশ্রুতি (অনুচ্ছেদ-১১) সরকারের কার্যক্রমে সবসময় প্রতিফলিত বা অনুসৃত হচ্ছে বলা যায় না।

ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার ব্যবহার বিষয়ে উপাত্তাদি আহরণ ও ব্যবহার ব্যক্তি স্বাধীনতার লংঘন বিবেচনা করে ইরান বা আফগানিস্তানে যেসব রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ব্যবস্থাপনামূলক কার্যাদি মানুষের মুক্তির ব্যত্যয়াদি বলে মুক্তবিশে^ বিবেচিত, তা অতীব সাবধানতার সঙ্গে আমাদের পরিহার করতে হবে।

কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমারে গোত্র বা দলের প্রতি আনুগত্য বজায় বা বাড়ানোর জন্য যেসব তথ্যাদি আহরণ বা ব্যবহার করা হয়, তা পরিহার করে চলা আমাদের মুক্তির সনদের অংশ বলে বিবেচনা করা, আমাদের মুক্তির অনুকূলে বিধেয় বলে সমাজ প্রশাসিত করতে হবে। অধুনা ব্যবসায়িক ও সামাজিক ব্যবহারে আগমনীয় বা ব্যবহার্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের প্রক্রিয়ায় তেমনি অপ্রয়োজনীয় তথ্যাদি যাতে সংগ্রহ বা ব্যবহৃত না হতে পারে, তার দিকেও আমাদের এখন থেকেই দৃষ্টি দেওয়া সংবিধানে অনুশাসিত স্বাধীনসত্তায় সমৃদ্ধি অর্জনের পথে সহায়ক বলে গণ্য করতে হবে।

সাংবাদিকতার বিকাশ এমনকি চর্চার ক্ষেত্রে আরোপণীয় নিষেধাজ্ঞাদি যাতে আইনের মোড়কে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতিকূলে না যায় কিংবা বহুবাচনিক মুক্ত সমাজের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হতে পারে, তার দিকে সচেতন থাকা গণতান্ত্রিকতার অনুকূল বলে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। শ্রমআইন প্রণয়ন ও প্রশাসনে ব্যক্তি বা আঁতেলধর্মী বিশ^াস যাতে স্বাধীন আচরণের বিরোধী পদক্ষেপ না হয়, তার নিশ্চয়তা বিধান জরুরি বলে বিবেচনা করতে হবে।
অধুনা উন্নয়নের লক্ষ্যে আমরা নতুনতর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছি। এসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের ক্ষেত্রের বাইরে সামাজিক প্রশাসনে যাতে অধিকতর ব্যত্যয় বা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি না করে, সেদিকে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। তেমনি সমৃদ্ধি যেন কোনোক্রমেই ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যত্যয় না ঘটায়, সেদিকে সচেতন থেকে আমাদের আইনি কাঠামো সংস্কার বা পুনর্গঠন করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের আর্থ-সামাজিক কার্যক্রম সযত্নে নিরিখ করে গণতান্ত্রিক সুরক্ষা ও প্রসারণে জাতিগতভাবে পূর্ণাঙ্গ চেতনাবোধ নিয়ে অগ্রসর হওয়া আমাদের বিধেয় হবে। টাও ও  পেই লিখিত উপরোক্ত দুটি বই আমাদের সরকারি কার্যাবলি ও তৎপরতা যাতে সাধারণ মানুষের মুক্তি-বিনাশী না হয়, সে বিষয়ে আমাদের নিশ্চিতভাবে সচেতন করবে।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা

×