ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদে নিরাপত্তা ॥ জনপ্রতিনিধিদের গণসংযোগ

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২০:২৬, ৭ এপ্রিল ২০২৪

ঈদে নিরাপত্তা ॥ জনপ্রতিনিধিদের গণসংযোগ

.

সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর প্রতিদিন সড়কে দুর্ঘটনায় প্রায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছেতবে বেসরকারি সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে অন্তত সাড়ে ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়অবশ্য বিআরটিএর তথ্য বলছে, গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৯৫টিএসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২৪ জনআহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৯৫ জনবাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর মৃত্যুর সংখ্যা ৪ হাজার ৪৭৫রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ৬ হাজার ৫২৪ জন এবং বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০২ জনরোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৭১৩ জনএর আগের বছর ২০২১ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজার ২৮৪২০২০ সালে ছিল ৫ হাজার ৪৩১ জন

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৭ হাজার ৮৩৭টি যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেএর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে, যা মোট দুর্ঘটনার ২২ দশমিক ২৯ শতাংশতারপর রয়েছে ট্রাক/কাভার্ডভ্যান ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, বাস/মিনিবাস ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ, অটোরিকশা ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৫ দশমিক ৩০ শতাংশঅন্যান্য যানবাহন বাকি দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তমাসের হিসাবে দেখা যায়, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন জুলাইয়ে, ৫৩৩ জনদুর্ঘটনার সংখ্যাও জুলাইয়ে বেশি, ৫৬৬টিগত বছর দুর্ঘটনায় সবচেয়ে কম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ফেব্রুয়ারিতে, ৩০৩ জনফেব্রুয়ারিতে দুর্ঘটনাও সবচেয়ে কম ছিল, ৩০৮টিবিআরটিএর দেওয়া দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর মাসে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ঢাকা বিভাগে ৮৮ জনসবচেয়ে কম মৃত্যু সিলেট বিভাগে ২৪ জনডিসেম্বরে সারাদেশে মারা গেছেন ৪৩৩ জন

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, বিদায়ী বছরে (২০২৩) দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫০৫ জন মারা গেছেনএর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০২ জনসমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন ১০ হাজার ৩৭২ জনএ সময় রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত ও ৪৭৫ জন আহত হয়েছেননৌপথে ১৪৮টি দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত হয়েছেনসড়কে গত বছর ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৫২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৩৯ আহত হয়েছেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ শতাংশের বেশিযাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, ২০২২ সালের চেয়ে বিদায়ী ২০২৩ সালে ছোট যানবাহনের সংখ্যা হঠা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া এবং এসব যানবাহন অবাধে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছেএতে ফিডার রোডে ৫৫ শতাংশ, জাতীয় মহাসড়কে ১৪ শতাংশ এবং রেলক্রসিংয়ে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছেতবে এবার আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনা কমেছে বলে জানিয়েছে এই সংগঠন২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৯৫০ চালক মারা যানগত বছর দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ঢাকা বিভাগেএখানে ১ হাজার ৭৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭১২ জন নিহত ও ২ হাজার ৩৮১ জন আহত হয়েছেনগত বছর ১৭ জানুয়ারি সবচেয়ে বেশি ৩৫টি দুর্ঘটনা ঘটে এবং ৭ জুলাই দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ৪১ জন মারা যানঅন্যদিকে কম দুর্ঘটনা ঘটে ২৬ মার্চদেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বাস্তবতায় সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারটি প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছেঘর থেকে রাস্তায় বের হলেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ও ভয় বিরাজ করেঈদকে সামনে রেখে দুর্ঘটনার শঙ্কা ও ভয় আরও বেড়ে যায়এ সময়টাতে রাস্তায় অতিরিক্ত মানুষের চাপ সামলানোর সুযোগে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, রুট পারমিটবিহীন গাড়ি রাস্তায় নেমে পড়েআবার ঈদের চাপ সামলাতে পুরনো গাড়িকে নতুন রং মাখিয়ে যাত্রীসেবা প্রদান করে উল্টো যাত্রীদের জীবনকে শঙ্কা ও হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কেন ঘটছে, কারা দায়ী, প্রতিকার কি হতে পারে-এ বিষয়ে মোটামুটি একটি ধারণা সবার জানাতদুপরি আমরা কেন ব্যর্থ হচ্ছি, সমাধানসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা কোথায়- সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করতে হবে নিবিড়ভাবেসকলেই জানি, অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যানবাহনে ভ্রমণ করা অনিরাপদকেন বারবার আমরা এ ভুল করতে যাচ্ছি? ওভারটেকিং দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণএ বিষয়গুলো জেনেও আমরা কেন মানার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছিসামান্য একটুখানি সময়ের জন্য জীবনকে বিকিয়ে দেওয়ার নজির দেখা যাচ্ছে অহরহএ জায়গায় আমাদের বোধোদয় কবে হবে? বাস মালিক, ড্রাইভার, পরিবহন শ্রমিক, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, যাত্রী সাধারণ প্রত্যেকের ভূমিকাকে কিভাবে ইতিবাচক করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের সম্মিলিত পরিসরে কাজ করতে হবেকিছুদিন আগে ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজশাহী সেন্টারের ডি-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে রাজশাহী যাওয়ার পথে আমাদের বহনকৃত বাসটি মারাত্মকভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় বাসটিরআমাদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা প্রত্যেকেই আঘাতপ্রাপ্ত হনযদিও গুরুতর আহত হয়নি কেউই (আমাদের কয়েক শিক্ষককে প্রাথমিক চিকিসা প্রদান করা হয়)তবে বাসটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়পরবর্তীতে অন্য পরিবহনের সহায়তায় প্রশ্নপত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে আমাদের টিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছেঅবাক করার মতো বিষয় হলো, আমাদের বাসটি সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রটোকলে ছিলতারপরেও দুর্ঘটনায় পতিত হয়মোটা দাগে এর জন্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা যেতে পারেরাস্তাঘাটে বিশেষ করে দূরপাল্লার যাত্রী হিসেবে সড়ক পরিবহন ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে উল্লিখিত কারণগুলো সহায়ক হতে পারেপ্রথমত, যে গাড়িটি যাত্রার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, গাড়িটি উক্ত রুটের নয়সঙ্গত কারণেই চালকের জন্য রুটটি নতুন হওয়ায় ড্রাইভিংয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিলদ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী এ দীর্ঘযাত্রায় গাড়িটি একজন ড্রাইভারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছিলএ দীর্ঘ যাত্রায় কমপক্ষে দুজন ড্রাইভারের প্রয়োজন ছিলতৃতীয়ত, রাস্তার গতিসীমা মানার ক্ষেত্রে ড্রাইভারের মধ্যে অপারগতা পরিলক্ষিত হয়েছে বেশ কয়েকবারবিশেষত গাড়িটি পুলিশ প্রটোকলকে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিলপুলিশ প্রটোকলে যে গাড়িসমূহ ব্যবহৃত হয়েছিল সে সবের গতি কম থাকায় সংশ্লিষ্ট গাড়ির ড্রাইভার প্রটোকলের গাড়ির গতিসীমাকে ক্রস করতে গিয়ে দ্বিধার মধ্যে ছিল (কখনো ক্রস করেছে, আবার কখনো প্রটোকলের গাড়িকে অনুসরণ করেছে)আমরা বারবার ড্রাইভারকে বলার চেষ্টা করেছি পুলিশের গাড়িকে অনুসরণ করে গাড়ি পরিচালনা করার জন্যসর্বোপরি ওভারটেকিং-এর কারণে গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়গাড়িটি যেখানে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় মূলত সেটি দুই লেনের রাস্তাঐ জায়গা আমাদের বহনকৃত গাড়িটি একটি ছোট মাইক্রোবাসকে ওভারটেকিং করার সময় ভিন্নদিক থেকে আসা কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় বাসটিরঘটনাটি ঈদ যাত্রায় যাত্রী সাধারণকে পরিবহন ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এবং ড্রাইভারকে সতর্ক হওয়ার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হতে পারে

নির্বাচনের কালে কিংবা মনোনয়ন প্রদানের কালে জনপ্রিয়তা যাচাই-বাছাইয়ের কারণেই হোক কিংবা দলের মধ্যে জনসম্পৃক্ততা দেখানোর জন্যই হোক, অনেক রাজনীতিবিদ ঢাকা ছেড়ে গ্রামমুখী হয়এ ধরনের রাজনীতিবিদগণই সাধারণত মৌসুমী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিততাদেরকে জনসমক্ষে বের হতে হবেগ্রামের মানুষের কাছে যেতে হবেকেননা, জনগণের ভোটেই তারা বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত হয়েছেনবর্তমানে হয়ত কেউ জনপ্রতিনিধিআবার অনেকেই ক্ষমতার বাইরে রয়েছেনতদুপরি প্রত্যেক রাজনীতিবিদের এলাকার মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছেসে জায়গা থেকে ঈদে প্রত্যেক রাজনীতিবিদের উচিত এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানোঅনেক রাজনীতিবিদ রয়েছেন যারা ভোটের হিসাব-নিকাশ শেষ হলে এলাকার মানুষের তেমন একটা খোঁজখবর রাখেন নাতাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক আহ্বান মানুষের খেদমতে আত্মনিয়োগ করুনজনতা প্রতিদান দেবেপ্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে এলাকার জনসাধারণের জন্য প্রেরিত উপহার সঠিকভাবে যারা সুবিধা পাওয়ার উপযুক্ত তাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবেআমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছিÑ কয়েক জনপ্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে প্রাপ্ত ঈদ সামগ্রীর একটি তালিকা তুলে ধরেছেন যার যার ব্যক্তিগত প্রোফাইলেএটিকে এক অর্থে ইতিবাচক বলা চলেকেননা এর মাধ্যমে জবাবদিহি ও বরাদ্দ নিশ্চিত হবেঈদ উপহার সামগ্রী যথাযথভাবে এলাকার মানুষদের মধ্যে বণ্টন করার দায়িত্ব নির্বাচিত জন্প্রতিনিধিরবাংলাদেশের সবকটি সংসদীয় আসনেই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়েছেসে অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিদেরও জবাবদিহিমূলক কর্মকা- সম্পাদনের উদ্যোগ নিতে হবেবিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট আসনের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি অনুদানের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের অবহিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবেপরিশেষে, সকলের ঈদযাত্রা আনন্দ ও নিরাপদ হোক এবং পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করে নিরাপদে সকলেই কর্মস্থলে ফিরে আসুক, এ প্রত্যাশাই করছি। 

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×