.
সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর প্রতিদিন সড়কে দুর্ঘটনায় প্রায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে বেসরকারি সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে অন্তত সাড়ে ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অবশ্য বিআরটিএর তথ্য বলছে, গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৯৫টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২৪ জন। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৯৫ জন। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর মৃত্যুর সংখ্যা ৪ হাজার ৪৭৫। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ৬ হাজার ৫২৪ জন এবং বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০২ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৭১৩ জন। এর আগের বছর ২০২১ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজার ২৮৪। ২০২০ সালে ছিল ৫ হাজার ৪৩১ জন।
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৭ হাজার ৮৩৭টি যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে, যা মোট দুর্ঘটনার ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ। তারপর রয়েছে ট্রাক/কাভার্ডভ্যান ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, বাস/মিনিবাস ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ, অটোরিকশা ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। অন্যান্য যানবাহন বাকি দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। মাসের হিসাবে দেখা যায়, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন জুলাইয়ে, ৫৩৩ জন। দুর্ঘটনার সংখ্যাও জুলাইয়ে বেশি, ৫৬৬টি। গত বছর দুর্ঘটনায় সবচেয়ে কম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ফেব্রুয়ারিতে, ৩০৩ জন। ফেব্রুয়ারিতে দুর্ঘটনাও সবচেয়ে কম ছিল, ৩০৮টি। বিআরটিএর দেওয়া দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর মাসে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ঢাকা বিভাগে ৮৮ জন। সবচেয়ে কম মৃত্যু সিলেট বিভাগে ২৪ জন। ডিসেম্বরে সারাদেশে মারা গেছেন ৪৩৩ জন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, বিদায়ী বছরে (২০২৩) দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫০৫ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০২ জন। সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন ১০ হাজার ৩৭২ জন। এ সময় রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত ও ৪৭৫ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে ১৪৮টি দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত হয়েছেন। সড়কে গত বছর ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৫২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৩৯ আহত হয়েছেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ শতাংশের বেশি। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, ২০২২ সালের চেয়ে বিদায়ী ২০২৩ সালে ছোট যানবাহনের সংখ্যা হঠাৎ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া এবং এসব যানবাহন অবাধে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে। এতে ফিডার রোডে ৫৫ শতাংশ, জাতীয় মহাসড়কে ১৪ শতাংশ এবং রেলক্রসিংয়ে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। তবে এবার আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনা কমেছে বলে জানিয়েছে এই সংগঠন। ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৯৫০ চালক মারা যান। গত বছর দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে। এখানে ১ হাজার ৭৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭১২ জন নিহত ও ২ হাজার ৩৮১ জন আহত হয়েছেন। গত বছর ১৭ জানুয়ারি সবচেয়ে বেশি ৩৫টি দুর্ঘটনা ঘটে এবং ৭ জুলাই দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ৪১ জন মারা যান। অন্যদিকে কম দুর্ঘটনা ঘটে ২৬ মার্চ। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বাস্তবতায় সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারটি প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘর থেকে রাস্তায় বের হলেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ও ভয় বিরাজ করে। ঈদকে সামনে রেখে দুর্ঘটনার শঙ্কা ও ভয় আরও বেড়ে যায়। এ সময়টাতে রাস্তায় অতিরিক্ত মানুষের চাপ সামলানোর সুযোগে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, রুট পারমিটবিহীন গাড়ি রাস্তায় নেমে পড়ে। আবার ঈদের চাপ সামলাতে পুরনো গাড়িকে নতুন রং মাখিয়ে যাত্রীসেবা প্রদান করে উল্টো যাত্রীদের জীবনকে শঙ্কা ও হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
॥ ২ ॥
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কেন ঘটছে, কারা দায়ী, প্রতিকার কি হতে পারে-এ বিষয়ে মোটামুটি একটি ধারণা সবার জানা। তদুপরি আমরা কেন ব্যর্থ হচ্ছি, সমাধানসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা কোথায়- সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করতে হবে নিবিড়ভাবে। সকলেই জানি, অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যানবাহনে ভ্রমণ করা অনিরাপদ। কেন বারবার আমরা এ ভুল করতে যাচ্ছি? ওভারটেকিং দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। এ বিষয়গুলো জেনেও আমরা কেন মানার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছি। সামান্য একটুখানি সময়ের জন্য জীবনকে বিকিয়ে দেওয়ার নজির দেখা যাচ্ছে অহরহ। এ জায়গায় আমাদের বোধোদয় কবে হবে? বাস মালিক, ড্রাইভার, পরিবহন শ্রমিক, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, যাত্রী সাধারণ প্রত্যেকের ভূমিকাকে কিভাবে ইতিবাচক করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের সম্মিলিত পরিসরে কাজ করতে হবে। কিছুদিন আগে ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজশাহী সেন্টারের ডি-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে রাজশাহী যাওয়ার পথে আমাদের বহনকৃত বাসটি মারাত্মকভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় বাসটির। আমাদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা প্রত্যেকেই আঘাতপ্রাপ্ত হন। যদিও গুরুতর আহত হয়নি কেউই (আমাদের কয়েক শিক্ষককে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়)। তবে বাসটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে অন্য পরিবহনের সহায়তায় প্রশ্নপত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে আমাদের টিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, আমাদের বাসটি সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রটোকলে ছিল। তারপরেও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। মোটা দাগে এর জন্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা যেতে পারে। রাস্তাঘাটে বিশেষ করে দূরপাল্লার যাত্রী হিসেবে সড়ক পরিবহন ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে উল্লিখিত কারণগুলো সহায়ক হতে পারে। প্রথমত, যে গাড়িটি যাত্রার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, গাড়িটি উক্ত রুটের নয়। সঙ্গত কারণেই চালকের জন্য রুটটি নতুন হওয়ায় ড্রাইভিংয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী এ দীর্ঘযাত্রায় গাড়িটি একজন ড্রাইভারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছিল। এ দীর্ঘ যাত্রায় কমপক্ষে দুজন ড্রাইভারের প্রয়োজন ছিল। তৃতীয়ত, রাস্তার গতিসীমা মানার ক্ষেত্রে ড্রাইভারের মধ্যে অপারগতা পরিলক্ষিত হয়েছে বেশ কয়েকবার। বিশেষত গাড়িটি পুলিশ প্রটোকলকে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিল। পুলিশ প্রটোকলে যে গাড়িসমূহ ব্যবহৃত হয়েছিল সে সবের গতি কম থাকায় সংশ্লিষ্ট গাড়ির ড্রাইভার প্রটোকলের গাড়ির গতিসীমাকে ক্রস করতে গিয়ে দ্বিধার মধ্যে ছিল (কখনো ক্রস করেছে, আবার কখনো প্রটোকলের গাড়িকে অনুসরণ করেছে)। আমরা বারবার ড্রাইভারকে বলার চেষ্টা করেছি পুলিশের গাড়িকে অনুসরণ করে গাড়ি পরিচালনা করার জন্য। সর্বোপরি ওভারটেকিং-এর কারণে গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। গাড়িটি যেখানে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় মূলত সেটি দুই লেনের রাস্তা। ঐ জায়গা আমাদের বহনকৃত গাড়িটি একটি ছোট মাইক্রোবাসকে ওভারটেকিং করার সময় ভিন্নদিক থেকে আসা কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় বাসটির। ঘটনাটি ঈদ যাত্রায় যাত্রী সাধারণকে পরিবহন ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এবং ড্রাইভারকে সতর্ক হওয়ার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হতে পারে।
॥ ৩ ॥
নির্বাচনের কালে কিংবা মনোনয়ন প্রদানের কালে জনপ্রিয়তা যাচাই-বাছাইয়ের কারণেই হোক কিংবা দলের মধ্যে জনসম্পৃক্ততা দেখানোর জন্যই হোক, অনেক রাজনীতিবিদ ঢাকা ছেড়ে গ্রামমুখী হয়। এ ধরনের রাজনীতিবিদগণই সাধারণত মৌসুমী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। তাদেরকে জনসমক্ষে বের হতে হবে। গ্রামের মানুষের কাছে যেতে হবে। কেননা, জনগণের ভোটেই তারা বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে হয়ত কেউ জনপ্রতিনিধি। আবার অনেকেই ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন। তদুপরি প্রত্যেক রাজনীতিবিদের এলাকার মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। সে জায়গা থেকে ঈদে প্রত্যেক রাজনীতিবিদের উচিত এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো। অনেক রাজনীতিবিদ রয়েছেন যারা ভোটের হিসাব-নিকাশ শেষ হলে এলাকার মানুষের তেমন একটা খোঁজখবর রাখেন না। তাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক আহ্বান মানুষের খেদমতে আত্মনিয়োগ করুন। জনতা প্রতিদান দেবে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে এলাকার জনসাধারণের জন্য প্রেরিত উপহার সঠিকভাবে যারা সুবিধা পাওয়ার উপযুক্ত তাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছিÑ কয়েক জনপ্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে প্রাপ্ত ঈদ সামগ্রীর একটি তালিকা তুলে ধরেছেন যার যার ব্যক্তিগত প্রোফাইলে। এটিকে এক অর্থে ইতিবাচক বলা চলে। কেননা এর মাধ্যমে জবাবদিহি ও বরাদ্দ নিশ্চিত হবে। ঈদ উপহার সামগ্রী যথাযথভাবে এলাকার মানুষদের মধ্যে বণ্টন করার দায়িত্ব নির্বাচিত জন্প্রতিনিধির। বাংলাদেশের সবকটি সংসদীয় আসনেই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। সে অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিদেরও জবাবদিহিমূলক কর্মকা- সম্পাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট আসনের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি অনুদানের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের অবহিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পরিশেষে, সকলের ঈদযাত্রা আনন্দ ও নিরাপদ হোক এবং পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করে নিরাপদে সকলেই কর্মস্থলে ফিরে আসুক, এ প্রত্যাশাই করছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়