ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ১৮ মার্চ ২০২৪

বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বাজারের যে অস্থিরতা

একদিকে ব্যবসায়ী চক্র মুনাফা আসক্তিতে মরিয়া, অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতা প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই দিশেহারা, মাথায় হাত পড়ার দুরবস্থা। তবে এবারের রমজান মাসে সাশ্রয়ী মূল্যে বেশ কয়েকটি পণ্য বিক্রি করার চিত্র সংশ্লিষ্টদের জন্য সুখবর। বিশেষ করে রমজানের প্রয়োজনীয় তেল, ময়দা, সেমাই, হলুদ, মরিচসহ বিভিন্ন পণ্য গ্রাহকদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে কয়েকটি মানবিক প্রতিষ্ঠান। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় এমন কম দামে পণ্য কিনতে পাওয়ার সুখবর অনেককেই নিশ্চিন্ত করেছে

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বাজারের যে অস্থিরতা সেটা থামাতে সরকার ইতোমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারপরও শুল্ক কমানো থেকে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার মতো পদক্ষেপগুলো এখনও তেমন কার্যকর হচ্ছে না বলে সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে। তবে সবচেয়ে দামি পণ্য রমজানের সময় পেঁয়াজের মূল্য এখন কমতির দিকে। ভোক্তা শ্রেণির জন্য স্বস্তিকর বিষয় তো বটেই। খেজুর ইফতারের অন্যতম মুখরোচক, সুস্বাদু খাবার।

সেখানে সরকার দাম নির্ধারণে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কিছুটা প্রশমিত হলেও অন্যান্য পণ্যের দাম মানুষকে বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি করছে। সাধারণ মানুষের চাহিদা মোতাবেক খেজুরের দাম নির্ধারণ করলে অপেক্ষাকৃত দামি খেজুর এখন অবধি সিন্ডিকেটের কবলে। এদিকে পেঁয়াজের দামও কমতে শুরু করেছে। যথা সময়ে ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ আসা শুরু করলে তা আরও কমার সম্ভাবনা প্রবল।

তবে সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিক্তিক খাদ্যপণ্য এখন মোটামুটি হাতের নাগালে যা সত্যিই এক আশ্বস্তের ব্যাপার। বিশেষ করে শাক-সবজির বাজার এখন সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে বলে খোদ ভোক্তা শ্রেণিই বলছেন। স্বস্তিদায়ক এক সহনীয় পরিবেশ। রমজান আসলেই কিংবা তারও আগে থেকে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ওপর যে মাত্রায় দাম চড়াও হয় তাতে সংশ্লিষ্টদের নাভিশ্বাস হওয়ার অবস্থা।

এবারের মাহে রমজান তেমন দুর্দশা থেকে কিছুটা নিরাপদ তো বটেই। তা ছাড়া বাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’। এমন অভিযানে সারাদেশে বিভিন্ন জেলা শহরে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করার তথ্যও উঠে আসছে। সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, ৪৮টি টিম যৌথভাবে বাজারে অভিযান চালিয়ে ১০৮ জনকে ৪৮ হাজার টাকা জরিমানার আওতায় এনেছে।

তবে রমজানের আগে থেকেই বাড়তি মূল্যে পণ্য কেনার চিত্র ছিল অসহনীয়। কোনো পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা আর সহনীয় অবস্থায় না ফেরাও গ্রাহকদের জন্য এক অপরিসীম টানাপোড়েন। রমজানের শুরুতেও দামের হেরফের বাজারে দৃশ্যমান হয়নি। তবে ধীরে ধীরে পেঁয়াজ থেকে আরম্ভ করে রোজার মাসের দরকারি পণ্যের দাম কমার দৃশ্য গ্রাহকদের স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে কাজ করে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের এমন অভিযানে মজুত করা পণ্যের দৃশ্যও হতচকিত হওয়ারই মতো।

তা ছাড়া মজুত করা খেজুরের মধ্যে সরাসরি তদারকিতে মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুরও সামনে চলে আসে। সত্যিই অসহনীয় এক দৃশ্য। ২০২১ সালের মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুরে নতুন স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করার চরম সর্বনাশা কার্যক্রমও উপস্থিত সবাইকে হতভম্ব করে দেয়। জেল-জরিমানা করে এমন অনৈতিক কাজের দায়ভার চুকানো যাবে কি? জানারও অতীত। অভিযান চলাকালে ফলের ব্যবসায়ী থেকে ইফতার বিক্রেতা- সবাই সামনের কাতারে চলে আসে।

ইফতারির দোকানে যথাযথ মূল্য তালিকা না থাকায় বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো মূল্য আদায় করে নিচ্ছে ক্রেতাদের কাছ থেকে। অন্যদিকে ফল বিক্রেতারাও তাদের অপরাধ জগৎকে চাপা দিতে পারেনি। ক্রেতাদের নানাভাবে হয়রানি করা থেকে দূরে রাখতে ফলের দোকানেও অসৎ বিক্রেতাদের সতর্ক করা হয় । যথার্থ মূল্য নির্ধারণ থাকা সত্ত্বেও কোনো মূল্য তালিকার অনুপস্থিতি অসাধু চক্রের আর এক মুনাফা অর্জনের নতুন কারসাজি।

চালের বাজারের নানামাত্রিক অপকর্মও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সামনে খোলাসা হয়ে যায়। চিরুনি অভিযানে দেখা যায় সাধারণ চাল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটে ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। এমন অপকর্ম হতবিহ্বল হওয়ারই মতো। শুধু অভিযান নয়, সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর জরিমানা করেও অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনছেন। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় বহু পুরনো এমন সব অপকর্ম ও অনৈতিক কর্মযোগ চালিয়ে যেতে কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। না ভোক্তা শ্রেণি, না আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর।

তার পরেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে বহাল তবিয়তে নিত্যনতুন কারসাজিতে তাদের অপকর্ম জোর কদমে চালিয়ে যাচ্ছে। জরিমানার আগ পর্যন্ত যা মুনাফা অর্জিত হয় তার সবই তো তুলে নেওয়া হয়। নিজেদের পকেট ভারি হয়। বিপরীতে ভোক্তা শ্রেণি নাভিশ্বাসের পর্যায়ে চলে যায়। ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা আবহমান বাংলা তার চিরায়ত শস্য ভাণ্ডারের অভাবনীয় সম্ভারে দেশ-বিদেশে নজর কাড়া।

সেখানে আধুনিক ও প্রযুক্তির নতুন বাংলাদেশ কোন্ অদৃশ্য কোপানলে সাধারণ মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনকে অস্থির করে তুলছে? খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমাদের এই শ্যামল বাংলা। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে চাহিদা তো বাড়েই। সে জন্য বরাবরই ঘাটতি পূরণে আমদানি ব্যবস্থাপনা তার সক্রিয় কর্মযোগে নিয়তই চলমান। বর্তমান সরকার সেই আমদানি শুল্কও কমিয়ে জনগণকে স্বস্তির জায়গায় নিয়ে যেতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবে বারবার সামনে আসছে আমদানি শুল্ক কমানোর প্রভাব সিন্ডিকেটের পকেটে।

খুচরা বিক্রেতা কিংবা সাধারণ ক্রেতা তার আওতার একেবারেই বাইরে। যা সরকারও মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য আজকের নয়। বহু যুগ আর কালের ধারাবাহিকতায় চলমান এক অপসংস্কার, অপকর্ম। তবে বিশ্বজুড়ে চলছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অসহনীয় দুর্বিপাক, সঙ্গে কিছু সহনীয় ব্যবস্থাপনাও চমক দেওয়ার মতো। এই পবিত্র মাহে রমজানে সৌদি আরবসহ বহু মুসলিম রাষ্ট্র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কমিয়ে গণমাধ্যম সরগরম করেছে।

বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে সারা বিশ্ব মূল্য ছাড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন আকর্ষণীয় উপহার প্রদানও আধ্যাত্মিক চেতনার পবিত্রতম পর্যায়। আর মুদ্রাস্ফীতি? মূল্যস্ফীতির প্রবল চাপে দেশের বাজারের কেনাকাটা কমে যাওয়ার চিত্রও সহনীয় নয়। খোদ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরই বলছে মুদ্রাস্ফীতির কারণে কেনাকাটা কমে যাওয়া প্রচলিত নিয়মের মধ্যেই পড়ে। যে হারে পণ্যের দাম বাড়ে সেখানে আয় রোজগার আগের স্থান থেকে নেমেও যায়। সব মিলিয়ে যে অসহনীয় দুর্গতি তার সব দায় ভাগ গিয়ে পড়ে অতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

আবার মধ্যবিত্ত শ্রেণিও সুখকর অবস্থায় থাকে না। প্রতিদিনের জীবন স্বাভাবিক নিয়মে নির্বাহ করতেও হিমশিম খেতে হয়। অপ্রয়োজনে সংসারের কেনাকাটায় কাটছাঁট করাও যাপিত জীবনের দিনলিপি। তার পরও মানুষের জীবন চলে, থেমে থাকার উপায়ই নেই। আর পবিত্র রমজান মাসের খরচ তো একটু বেশি মাত্রার। পরবর্তীতে অপেক্ষমাণ থাকে বহুল প্রত্যাশিত ঈদ উৎসব। সেখানেও কেনাবেচার এক অবিমিশ্র জোয়ার।

একদিকে ব্যবসায়ী চক্র মুনাফা আসক্তিতে মরিয়া, অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতা প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই দিশেহারা, মাথায় হাত পড়ার দুরবস্থা। তবে এবারের রমজান মাসে সাশ্রয়ী মূল্যে বেশ কয়েকটি পণ্য বিক্রি করার চিত্র সংশ্লিষ্টদের জন্য সুখবর। বিশেষ করে রমজানের প্রয়োজনীয় তেল, ময়দা, সেমাই, হলুদ, মরিচসহ বিভিন্ন পণ্য গ্রাহকদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে কয়েকটি মানবিক প্রতিষ্ঠান। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় এমন কম দামে পণ্য কিনতে পাওয়ার সুখবর অনেককেই নিশ্চিন্ত করেছে।

তা ছাড়া সারাদেশের ২০টি স্থানেও সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কেনার সুযোগ রেখেছে সংশ্লিষ্ট মানবিক, জনবান্ধব কিছু প্রতিষ্ঠান। এটি এক মহতী উদ্যোগ। অতি সাধারণ মানুষ একটু কম দামে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার সুযোগ পাচ্ছেন বিশেষ ব্যবস্থায়। মানুষ মানুষের জন্য এমন চিরায়ত বোধ থেকে অনেক মহানুভব, জনদরদী ব্যক্তি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে তাদের সহায় সম্পদ বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করেন না এমন স্বস্তিকর চিত্র যুগ-যুগান্তরের।

সম্প্রীতির বাংলাদেশ আবহমান কালের শস্য ভা-ারের উর্বর এক পীঠস্থান। পলিমাটি ঘেরা এই দেশটিতে বীজবপন মাত্রই সফল সজীব হয়ে ওঠে। সমুদ্র পরিবেষ্টিত ও নদীবিধৌত বাংলার নরম পলিমাটি তার আঞ্চলিক সম্ভারে জাতি গোষ্ঠীকেও করেছে উদার, নরম আর মানবিক। তেমন বহু ক্ষেত্রে মানবিক কর্মযোগ আজও বাংলা ও বাঙালির এক অভাবনীয় শৌর্য। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রচলিত ফসল উৎপাদনে তো ঘাটতি দেখা দেবেই। কারণ মানুষ বাড়ে কিন্ত জমি একই পরিমাপে স্থির থাকে।

ফলে বিভেদ তো তৈরি হবেই। সংকট মোকাবিলা করাও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। জনসংখ্যাবিদ ম্যালথাস বলেছিলেন সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে- জনগোষ্ঠী বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর সম্পদ গাণিতিক হারে। সেখানে সামাজিক সমস্যা উদ্ভূত হয় জনসংখ্যা আর সম্পদের ফারাকের কারণে। আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে আধুনিক, উন্নত ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ গড়ার মহাসন্ধিক্ষণে। পাশাপাশি হরেক বিপণœতাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে সময় নিচ্ছে না।

সমাজবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক বলেছেন- উন্নয়ন-অনুন্নয়ন একই মুদ্রার উল্টো পিঠ। কারণ যে প্রক্রিয়ায় উন্নয়নকে ধরাছোঁয়ার আয়ত্তে আনা হয় তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় অধোগতি কাঠামোর অভ্যন্তরে জিইয়ে থাকে। বিজ্ঞানী নিউটন বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আরও একটি বাস্তব কথা জনসমক্ষে উন্মোচন করেন। তার দেওয়া তৃতীয় সূত্রে অভিমত ছিলÑ প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।

আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তির বাংলাদেশে তেমন সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নিজেদের অবস্থানে সামনে এগিয়ে চলছি। তাই ভালো-মন্দের সংমিশ্রণে উন্নয়নযজ্ঞ যেমন দৃশ্যমানÑপাশাপাশি নানামাত্রিক বিপণœতা, অধোগতি, দুর্বিষহ সময়কে মেনে নেওয়া সবই এক সঙ্গে গ্রথিত সুসংবদ্ধ মালা। তার পরও কিছু ব্যতিক্রমী আর অন্য রকম দৃষ্টান্ত দুর্ভোগের ক্রান্তিকালেও মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়।

সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়াতেও পেছনে তাকায় না। তা না হলে সামাজিক দুরবস্থা আরও অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেত। আমরা পবিত্র মাহে রমজানের ইবাদত বন্দেগির মাস পালন করি। শুধুমাত্র আল্লাহ-রাসূলের প্রতি পরম সমর্পণই নয় বরং আধ্যাত্মিক চেতনায় সেহরি আর ইফতারি গ্রহণ ও ধর্মীয় বিধিবিধানের অধীন। সেখানে কোনো কারসাজি, কার্পণ্য কাক্সিক্ষত কিংবা প্রত্যাশিত নয়।

লেখক : সাংবাদিক

×