ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সামাজিক নিরাপত্তা

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

প্রকাশিত: ২০:৫১, ১৮ মার্চ ২০২৪

বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সামাজিক নিরাপত্তা

কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মূল কর্তব্য হচ্ছে জনগণকে সেবা দেওয়া

কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মূল কর্তব্য হচ্ছে জনগণকে সেবা দেওয়া। বিশেষত যেসব মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা দেওয়াই হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল কাজ। আমরা বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অসংখ্য কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। তবে এই ধরনের সুবিধা উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় দেওয়া হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর অনুশীলন তেমন দেখা যেত না।

কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর দূরদর্শী জ্ঞান থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে গঠনমূলক রূপ দানে সক্ষম হয়েছেন।
সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তিগত উপকারভোগীদের সুরক্ষা ও কল্যাণের প্রসার করা। টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হলো- উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সকল নাগরিককে সম্পৃক্ত এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বৈষম্যহীন সামাজিক কাঠামোয় সকল নাগরিকের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তন করার বিষয়ে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করাসহ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোষণা প্রদান করেন। এর ধারাবাহিকতায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ প্রণীত হয়।

যার অধীনে প্রধানমন্ত্রী গত ১৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখ সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ, যা সকল নাগরিকের অবসরকালীন আর্থিক মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শনের আওতায় ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী ও সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সমাজের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে একটি সুসংগঠিত সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো বিনির্মাণ করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ থেকে জানা যায়, দেশের পশ্চাৎপদ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বয়স্ক জনসংখ্যা কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে। এমন হলে তখন বয়স্ক ভাতা, পেনশন স্কিম বাড়াতে হবে। ভবিষ্যতে এটি অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সেক্ষেত্রে একই সঙ্গে তাদের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কেমন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বয়সের কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনো তরুণের সংখ্যা অধিক। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বয়স্ক জাতির পর্যায়ে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। ৫০ বছর বা তার চেয়েও বেশি বয়সের লোকের সংখ্যা ২০৫০ সালে চার কোটির ঊর্ধ্বে পৌঁছে যেতে পারে। সুতরাং পরবর্তী তিন দশকের প্রতিটি সময়ই ১০ মিলিয়ন অতিরিক্ত প্রবীণ নাগরিকের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার নাগরিকদের জন্য বয়স্ক ভাতা ও সর্বজনীন পেনশনের একটি পদ্ধতি পরিচালনা করে আসছে।

অন্তর্ভুক্তকরণে সামাজিক পেনশন উল্লেখযোগ্য প্রসার লাভ করেছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অন্তর্ভুক্তি এখনো কম এবং হস্তান্তরিত অর্থ প্রদান অপ্রতুল বলে প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৭২.৩ বছর হলেও ভবিষ্যতে গড় আয়ু আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬২% কর্মক্ষম। ৬৫ বছর ঊর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭%, যারা মূলত কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল।

২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২৫% এ উন্নীত হবে। একই সঙ্গে গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে ভবিষ্যতে নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধি পাবে বিধায় একটি টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। ১৮ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনা সম্ভব হলে তারা একটি সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতাভুক্ত হবেন। সেলক্ষ্যে দেশের ১০ কোটি নাগরিককে সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা কার্যকর হলে আমাদের বয়স্ক জনসাধারণের সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে।
সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে এর কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্পূর্ণ আইটি প্ল্যাটফর্মে সর্বজনীন পেনশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটির উন্নয়ন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন বাড়ছে এবং পুঁজিও বাড়ছে।
২০০৮ সালের আগে বাংলাদেশের কোনো সরকারই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এত ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়ার সাহস দেখায়নি। দিনবদলের সনদকে সামনে রেখে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার বিভিন্ন ব্যতিক্রমী কর্মসূচি হাতে নেয়।

এরই অংশ হিসেবে দরিদ্র এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার অভিপ্রায়ে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বর্তমান সরকার। ২০০৯ সালের বাস্তবতায় এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেকের কাছে তা হাস্যকর মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত কর্মসূচির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ।

গত প্রায় ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত জনগণের হৃদয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে দাগ কেটেছে, তার মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা  অন্যতম।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে গেছেন শেষ দিন পর্যন্ত। তাঁর জীবনের মূল দর্শন ছিল বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। বাবার আদর্শকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় চেষ্টা করে চলেছেন দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। এ ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচির ভিত্তিতে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মেধা ও শ্রম দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে ক্রমেই। উপকারভোগী ব্যক্তি ও পরিবার হীনম্মন্যতা কাটিয়ে একটি সম্মানজনক জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার স্বপ্ন দেখছে। যা একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

sultanmahmud.rana@gm

×