ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ১৭ মার্চ ২০২৪

শিক্ষায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি

.

লন্ডন শহরের অন্যতম আর্কষণীয় স্থান হলো এক্সেল এক্সিবিশন সেন্টার। থেমসের পাড় ঘেঁষে গড়ে তোলা এই অতি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত কেন্দ্রটি মূলত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের স্থান, যেখানে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন ধরনের দেশীয় আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান, মেলা, প্রদর্শনী, বিজ্ঞান প্রযুক্তি সম্মেলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিবছর জানুয়ারিতে এখানে বসে বেট ফেয়ার।

বিশ্বজুড়ে এই সময়ে শিক্ষায় যেসব বৈপ্লবিক প্রযুক্তি গ্রহণ করা হচ্ছে কিংবা নতুন যেসব প্রযুক্তির ব্যবহারে শিক্ষার পরিবেশ আরও উন্নত, আকর্ষণীয় সহজ করে তোলা যেতে পারে- সেসব উদ্যোগকে এক নজরে এক ছাদের তলায় দেখতে পারার এর চেয়ে দারুণ সুযোগ আর হতে পারে না। এই মেলায় বিশেষভাবে কম্পিউটার টেকনোলজি, অনলাইন শিক্ষা, -লার্নিং, ক্লাসরুম ব্যবস্থাপনার সফটওয়্যার ইত্যাদির প্রদর্শন বিক্রি হয়। দিনভর নানা ধরনের ওয়ার্কশপের আয়োজন থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিকপাল উদ্ভাবকরা বক্তৃতা করেন। ছোট-বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক, প্রশাসকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তো থাকেই, কোনো কোনো স্কুল তাদের বাচ্চাদের দল বেঁধে নিয়ে আসে এই মেলা উপভোগের জন্য। বেশিরভাগ স্কুলই তাদের বিভাগীয় প্রধানদের বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে এই মেলায় পাঠান, যাতে নতুন প্রযুক্তির মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে ব্যবহার উপযোগী কোনো সফটওয়্যার বা টেকনোলজির অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে পারে, যেটা পরবর্তীতে প্রয়োজন মতো স্কুলে ব্যবহার করা যেতে পারে। মেলাটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। বেশ চওড়া দামের টিকেট কেটে তবে ওখানে ঢুকতে পারা যায়। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ফ্রি টিকেটের ব্যবস্থা আছে। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া মেলাটিতে গেলাম একদিন।

ভেতরে ঢুকতেই রীতিমতো হকচকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্রযুক্তি মেলা হিসেবে কী দেখতে যাচ্ছি- তা কিছুটা জানাই ছিল যদিও, কিন্তু আকার প্রকারে তার পরিধি আঁচ করাও মুশকিল হবে- সেজন্য প্রস্তুত ছিলাম না। বিশাল মেলার প্রান্ত থেকে প্রান্ত শত শত স্টল তাদের স্ব স্ব প্রযুক্তি প্রদর্শনে অভিনব সব কায়দা ব্যবহার করছে। স্ক্রিনে স্ক্রিনে চারদিক এমন ভাবে সাজানো যেন ভবিষ্যতের পৃথিবীর কোনো জায়গায় চলে এসেছি। যে কোনো স্টলের সামনে যেতে না যেতেই প্রশিক্ষিত স্টল-কর্মচারীরা তাদের প্রযুক্তির গুণগান বর্ণনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শিক্ষক পরিচয় পেলে তারা আরও দ্বিগুণ উৎসাহে কাজটি করেন। কেবল বর্ণনা করেই ক্ষান্ত থাকেন না, প্রযুক্তিটির হাতে-কলমে ব্যবহার দেখিয়ে তবে ছাড়েন। বাচ্চাদের শেখানোর জন্য বর্তমানে এত সম্ভব-অসম্ভব সব সফটওয়্যার যে তৈরি হচ্ছে, তা না দেখলে বর্ণনা সত্যিই মুশকিল। এত প্রযুক্তির তুলনায় আমাদের স্কুল জীবনটাকে মনে হতে লাগল কোনো প্রস্তর যুগের সময়! কেবল যা পড়াতে চাওয়া হচ্ছে- সেটা বাচ্চাদের কাছে আরও কার্যকরভাবে পৌঁছানোর জন্যই নয়, পুরো স্কুল সিস্টেমটিকে আক্ষরিক অর্থেই হাতের মুঠোয় এনে ফেলার সব জোগাড়যন্ত্র তৈরি হয়ে গেছে। একটি প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর প্রত্যেকের শিক্ষাযাত্রার যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সেকেন্ডের মধ্যে দেখা, বিচার-বিশ্লেষণ করে সে ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর উপযোগী শিক্ষা প্রদানের দিকনির্দেশনা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে সফটওয়্যারের কারসাজিতে। বিশেষ করে প্রযুক্তিবিষয়ক বিষয়গুলো শেখানোর জন্য যেসব সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে, তা এককথায়- ‘মাইন্ডব্লোয়িং

অসংখ্য প্রযুক্তির মধ্যে আজকে বিশেষত যেটির কথা বলতে বসা, সেটি হলো মেটার ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হ্যাডসেট। মেটার স্টলটি ছিল মেলার এক প্রান্তে। ফলে, ঘুরতে ঘুরতে বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন ওখানে গেলাম, বিশাল লাইনের খপ্পরে পড়ে যেতে হলো। ওদের স্টলটি খানিকটা উঁচু পাটাতনের ওপরে করা। লোকজন লাইন ধরে আছে। একজন করে দর্শনার্থীকে কর্মচারীরা ডেকে নিয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। মেটার এই হ্যাডসেটের কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত চেখে (!) দেখা হয়নি বিধায়, ভাবলামÑ যত দেরিই লাগুক, অভিজ্ঞতাটা নিয়ে যাই। একঠায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর যে অভিজ্ঞতা লাভ হলো, তাতে এক ঘণ্টা অপেক্ষায় রাখার দোষ মাফ করতে বিন্দুমাত্র সময় লাগল না। আমাদের চেনা-জানা পৃথিবী যে হারে বদলে যাচ্ছে, মেটার হেডসেট মাথায় দিয়ে মনে হলোÑ তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে যেতে হয়!

কী দেখলাম, তা বলার আগে একটা সরল স্বীকারোক্তি দেওয়া দরকার। নিজে প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষক হলেওঅতিরিক্ত মাত্রার প্রযুক্তিআমাকে ঠিক সুখী করে না। এটা আমার খানিক কূপম-ূকতার ফলও যদি হয়- তবু তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। স্মার্টফোনকে আমার এখনো প্যারোলে মুক্তি পাওয়া প্রিজনারের পায়ে লাগানোট্রেকারবলে মনে হয়। অতিরিক্ত মাত্রার আকস্মিক প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং ঢালাও ব্যবহার যে সামগ্রিকভাবে মানব প্রজাতিটিকেই একটি জটিল পরিবৃত্তিক জটিলতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, আমাদের হাজার হাজার বছর ধরে প্রায় অপরিবর্তিত থাকা মানবদেহ এবং মস্তিষ্ক যে হঠাৎ হুড়মুড় করে উন্মুক্ত হওয়া প্রযুক্তির জোয়ারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে বিষম খাচ্ছে- বর্তমান কালের অনেক দার্শনিক এবং প্রযুক্তিবিদ এবং সমাজবিদের সঙ্গে একমত পোষণ করি।

প্রসঙ্গে ফিরে যাই। যে কোনো বিচারেই মেটার ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তি ক্ষেত্রে (বিশেষত শিক্ষা-সম্পর্কিত প্রযুক্তিতে) একটা উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন এবং সত্যিকার অর্থে, বস্তুটি মন কেড়ে নিয়েছে। যে সেশানে যোগ দিয়েছিলাম, সেটি ছিল রসায়ন বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরির সেশান। আমার পালা আসতেই মেটার ভদ্রলোকটি মাথায় হেডসেটটি পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, রেডি? অতিকায় সাইজের হ্যালমেট সদৃশ (নাক থেকে নিচের দিকটা অবশ্য খোলা) চশমাটি চোখে মাথায় পরে ঠিক কীসের জন্য রেডি হবোÑ তা বুঝতে না বুঝতে সায় দিয়ে বললাম, রেডি। আর এক সেকেন্ডের মধ্যে আমার চোখের সামনে দুনিয়া বদলে গেল। স্পষ্ট দেখলাম, যেন একটা অতি আধুনিক সুসজ্জিত রসায়নের ল্যাবরেটরিতে দাঁড়িয়ে আছি। চোখের সামনে যে ঝকঝকে কাচের জারে থরে থরে সাজানো আছে নানারকমের এসিড, লবণ, গ্যাস। নানা ধরনের টেস্টটিউব, নল, আরও কত কত যে যন্ত্রপাতি। এই এসিড নিয়ে টিউবে ঢাললাম, অন্য একটা এসিড নিয়ে মেশালাম তাতে, মিশ্রণে তৈরি হলো অন্য কী যেন। যাই করছি, সঙ্গে সঙ্গে তার তথ্য টাইপ হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে ঝুলে থাকা বোর্ডে। আমার পরীক্ষায় কী ফল পাওয়া যাচ্ছে, কোন্্টি কোন্্ ধরনের বস্তু, এদের মেশালে কী হবে- তার বিবরণও ঝুলছে একই সঙ্গে। কত শতাংশ বস্তুর সঙ্গে কত শতাংশ বস্তুর মিশ্রণের ফলাফল লেখা হয়ে রইল সঙ্গে সঙ্গে। চাইলে হাত বাড়িয়ে আমি লিখে রাখতে পারছি পরীক্ষার ফলাফল। আর এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফলের তথ্যে উপাত্তে তৈরি হচ্ছে- সুদৃশ্য গ্রাফ।

আমার ভুল মিশ্রণে কয়েকবার আগুন ধরে যাওয়ার মতো ধোঁয়া তৈরি হলো, হাতের ধাক্কায় গ্লাস বিকার পড়ে চুরমার হয়ে গেল। জীবনের কোনো পর্যায়ে আপনি যদি আমার মতো রসায়ন বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে থাকেন, তাহলে বুঝবেন, রসায়ন বিজ্ঞান (কিংবা যে কোনো ধরনের বিজ্ঞানই হোক না কেন) শেখার জন্য ল্যাবরেটরির কোনো বিকল্প নেই। অথচ, বাস্তবতা হচ্ছে, শত শত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সূত্র, ফলাফল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে স্রেফ মেনে নিয়ে মুখস্থ করতে হয়। এদিকে নিয়মিতভাবে সেরকম কোনো ল্যাবরেটরির সুবিধা প্রদান করা বিশাল ঝক্কির বিষয়। সেটার রক্ষণাবেক্ষণ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বস্তুর জন্য যে পরিমাণ খরচ করতে হয়, তা খুব কম স্কুলই বহন করতে পারে। তার ওপর এসব ল্যাবরেটরিতে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকে সবসময়ই। কিন্তু ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সুবিধা এই সব বাধাকে এক ধাক্কায় দূর করে দেবে নিকট ভবিষ্যতের ক্লাসরুমগুলোকে। বইয়ে পড়া প্রতিটি বৈজ্ঞানিক তথ্যকে হাতে-কলমে পরখ করে নেওয়ার সুবিধা পাবে আগামীর ছাত্র-ছাত্রীরা। একই সঙ্গে নিজেদের কৌতূহলটিকে মেটানোর জন্য কোনোরকম বিপদের শঙ্কা সরিয়ে রেখে মেতে উঠতে পারবে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। পত্রিকায় পড়লাম, অনেক মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে মড়া কাটছে, আসল মানুষের গায়ে ছুরি বসানোর আগে ভার্চুয়াল মানুষের গায়ে ছুরি বসাচ্ছে- যত ভুল-চুক করার করে নিচ্ছে রিয়েল ওয়ার্ল্ডে আসার আগে। দক্ষ ডাক্তার বানানোর ব্যাপারে বিষয়টার প্রভাব একবার ভাবুন!

সম্প্রতি ডেনমার্কে একটা ছোট্ট গবেষণা হয়েছে। অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে দুইভাগে ভাগ করে নিয়ে একভাগকে কেবল ল্যাবরেটরি-বেজড শিক্ষা এবং অন্যভাগকে সেই বিষয়টাই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বেজড শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। জরিপের আগে তাদের বিষয়ে দুটো টেস্ট নেওয়া হয়েছিল। দেখা গেছে যে, প্রচলিত ল্যাবরেটরির বেজড শিক্ষার তুলনায় যেসব ছাত্র-ছাত্রী ভাচুর্য়াল রিয়েলিটির হেডসেট ব্যবহার করে শিখেছে, তাদের শিক্ষার গুণগতমান প্রায় ৭৬% বেড়ে গেছে। কেবল ছাত্র-ছাত্রীদের মানই নয়, যে শিক্ষকরা শিক্ষা দিচ্ছেন, একই সময়ে তাদের শিক্ষা প্রদানের গুণগত মানও বেড়ে গেছে অন্তত ১০১% -!

মাত্র দশ মিনিট সময়। মনে হচ্ছিল, মেটার জগতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে কোনো অসুবিধা হতো না যদি সুযোগ পাওয়া যেত। কেননা, জগতটায় কেবল পড়াশোনা নেই, আছে পড়াশোনা-অভিজ্ঞতালদ্ধ হওয়ার অপূর্ব সুযোগ। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি যে দুনিয়ার দরজা খুলে দিচ্ছে - তা আক্ষরিক অর্থেই অনন্ত। মানুষের অতলান্তিক কল্পনার পরিধি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পরিধি। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, আগামী প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের আমাদের প্রজন্মের মতো কোনো কিছুই আর মুখস্থ করতে হবে না। বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য সব জ্ঞানকে কেবল বইয়ের পাতা থেকে তোতা পাখির মতো না শিখে, নিজের হাতে ঘেঁটে ঘুঁটে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবে জ্ঞানীর হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা এই অপার সুযোগ কাজে লাগিয়ে সমাধান করে ফেলবে বর্তমান পৃথিবীর অসংখ্য সমস্যাÑ এই আশাবাদে পুরোপুরি বিশ্বাস করি। 

  ১৭ মার্চ ২০২৪

×