ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় শিল্প-সংস্কৃতি

ওয়ালিউর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ১ জানুয়ারি ২০২৩

ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় শিল্প-সংস্কৃতি

.

১৭৯৫ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে বাংলা নাটকবাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির নানা শাখায় বিপুল পরিমাণ নাট্য-উপাদান বহু পূর্ব থেকেই ছিলএক সময় বাংলাদেশে গ্রামে-গ্রামে চলত লোকসংগীত, পালাগান, জারিগান, গাজীরগান, কবিগান, ময়মনসিংহ গীতিকা, যাত্রাপালা বিশেষ করে শীতকালে এবং সেখানে শত শত নারী-পুরুষ বারোটা-একটা পর্যন্ত একসঙ্গে রাত জেগে দেখে বাড়ি ফিরতগ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই তা উপভোগ করততখন এগুলোই ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যমকালক্রমে এসব উপাদান থেকেই আধুনিক যুগের বাংলা নাটকের উদ্ভব ঘটে।  খ্রিস্টপূর্বকাল থেকেই গ্রিক দেশে নাট্যচর্চার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা জানা যায়পেরিফ্লিসের গ্রিক এবং পরবর্তীকালে এলিজাবেথের ইংল্যান্ডে নাট্যচর্চায় ব্যাপক সমৃদ্ধি এসেছিলপ্রাচীন ভারতবর্ষেও সংস্কৃত নাটক ছিল খুব সমৃদ্ধবর্তমানে পৃথিবীর সব দেশেই নাট্যচর্চা আছেবাংলা নাটকের ইতিহাস সুদীর্ঘকালেরদেশবিভাগের পর থেকেই পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে নাটক রচনায় একটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশের নাট্যকাররা ঐতিহাসিক নাটকের পাশাপাশি সামাজিক নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন

১৯৪৭ থেকে প্রাক-মুক্তিযুদ্ধকালপর্বে যারা নাটক লিখেছেন তারা হলেনÑ নুরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সিকান্্দার আবু জাফরপরে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র্র করে অনেক নাট্যকার নাটক লিখেছেনযেমনÑ মমতাজউদদীন আহমদের- স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ (১৯৭৬), আলাউদ্দিন আল আজাদের- নরকে লাল গোলাপ’ (১৯৭৪)আরও অনেকে আছেন যারা নাটক লিখেছেন এবং সমানতালে মঞ্চে ও টিভি নাটকে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখিয়েছেনতাদের মধ্যে প্রধান মামুনুর রশীদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আল দীন, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখনাটক আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের বিশাল স্থান দখল করে আছেসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারীব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে জনসমর্থন তৈরি করে জনতাকে জাতীয়তা বোধে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে মঞ্চস্থ হওয়া যাত্রাপালা এবং নাটক বড় ভূমিকা রেখেছেমানবিক মূল্যবোধ বিকাশ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধ তৈরিতে নাটকের ভূমিকা অনস্বীকার্য

বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রসংবিধানের অন্যতম একটি মৌলিক বিষয় ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাধর্মনিরপেক্ষবাদ বলতে সাধারণত রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথকরূপে প্রকাশ করাকে বোঝায়ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে সেখানেধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজমশব্দটি ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব ইলিয়ক প্রথম ব্যবহার করেনজর্জ জ্যাকব ধর্মের কোনো রকম সমালোচনা ছাড়া, সমাজে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা প্রকাশ করেন

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২-এর সংবিধান রচিত হয়সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদযা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহির্প্রকাশ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক কণ্ঠে ঘোষণা করেনÑ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব-স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবেধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে নাযদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে

পাকিস্তান আমলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মের নামে যে নির্যাতন পাকসেনারা করেছিল, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সাংবিধানিক কাঠামোয় উপস্থাপন করেছিলেনরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে জিয়াউর রহমান পঞ্চম এবং এরশাদ অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে পুরোপুরি পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলপরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তা আবার বহাল রাখা হয়

আমরা এত যুদ্ধ করছি দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখার জন্যআর সেই জায়গায় জামায়াত-হেফাজত-বিএনপি সারা বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিল করে ধর্মকে ব্যবহার করে, মিথ্যা কথা বলে ধর্মপ্রাণ মুসলমান নারী-পুরুষকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অতীত থেকেই করে আসছে২০২০ সালের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজতে ইসলামের তকালীন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বিভিন্ন বিতর্কমূলক বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়তার নেতৃত্বে গত ২৬, ২০২১ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরাসেই বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়ওই সংঘাতে প্রাণ হারান অন্তত ১৮ জন১৮ এপ্রিল তাকে গ্রেপ্তার করা হয়

এভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে কখনো জামায়াত, কখনো হেফাজত আবার কখনো বিএনপি মানুষের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে থাকে, যা পরবর্তীতে সহিংসতায় রূপ নেয়এর খেসারত দিতে হয় এদেশের সাধারণ মানুষকেনাটকের মাধ্যমে সমাজের প্রতি বার্তা দেওয়া যেতে পারেনাটক হচ্ছে সমাজ নির্মাণের হাতিয়ারসামাজিক অনাচার, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ও কুসংস্কার নিয়ে তৈরি নাটক আমাদের সমাজকে সব সময়ই নাড়া দিয়েছেপরিবর্তন এনেছে সমাজ ও মননেসমাজকে পরিশুদ্ধ করতে, সঠিক ধারায় প্রবাহিত হতে, সমাজের অসঙ্গতি ও অনাচার দূর করার ক্ষেত্রে, মানবিকতা ও মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে নাটক বড় অবদান রাখতে পারে

নাটকের মাধ্যমে অনেক বিষয়ে সচেতন করা যায় মানুষকেআজকাল মানুষের হাতে হাতে মোবাইলযখন খুশি ইউটিউবে নাটক, সিনেমা উপভোগ করতে পারছেতাই ভালো জিনিসের পাশাপাশি যখন খারাপ কিছু দেখানো হয়, সেটাও মানুষের মনে প্রভাব ফেলেআজকাল অনেক নাটকে ধূমপান এবং অ্যালকোহলের বিষয়গুলো বেশি দেখানো হচ্ছেযা তরুণ প্রজন্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছেআর এই দুটো জিনিসই স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকরএই জিনিসগুলো যতটা সম্ভব পরিহার করা ভালো

সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নাটক ও নাট্যকর্মীরা অতীতে যেমন ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি বর্তমান প্রজন্মের কিছু তরুণ আছেন, যারা তাদের সুনিপুণ অভিনয় দিয়ে ভূমিকা রাখছেনযেমনÑ জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, মেহজাবিন চৌধুরী, তানজিন তিশা, তাসনিয়া ফারিন, আফরান নিশোÑ এ রকম আরও অনেকে আছেনতাই আগামী দিনের সেক্যুলারিজম বাংলাদেশ যখন আমরা দেখব, তখন এর প্রধান ধারক এবং বাহক হবে তারাই

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সচিব

×