.
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি চেতনা ও অধ্যায়ের নাম। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এই দুটি নাম একে অপরের পরিপূরক, যা আজ ঐতিহাসিকভাবে সমাদৃত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই মহানায়ক। তাঁর দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের পথ ধরেই বাঙালী জাতি বিজয় অর্জন করে। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে এই দেশ অর্জন করে স্বাধীনতা। হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করেন। তিনি ছিলেন রাজনীতির কবি।
পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে তিনি বাঙালী জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। এ মুক্তির সংগ্রামে তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন। পাকিস্তানী শোষকচক্রের বিরূপ মনোভাব বুঝতে পেরে তিনি ১৯৪৭-এ দেশভাগ হওয়ার পর থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। বঙ্গবন্ধু সেই লক্ষ্যে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছেন এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে ছিনিয়ে আনেন বিজয়। তারপর থেকে তিনি যুক্ত হন আরেক সংগ্রামে। যার মূলমন্ত্র ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠন। তিনি এই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন সারা বিশে^র নেতা। সারা পৃথিবীর শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি। তাই তো তিনি বিশ্বনেতা। বিশ^সভায় বাংলাদেশের একমাত্র ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আত্মনিয়োগ করেছিলেন জাতি গঠনে। দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক নিরাপত্তাসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। দেশের অন্যান্য সম্ভাবনাময় সেক্টরের মতো পর্যটন শিল্প নিয়েও তার পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কারণে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা, থানা ঘুরেছেন। তিনি এই দেশের অপার সম্ভাবনা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন বারংবার। তাই তো ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের পর তিনি পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন এই দেশের উন্নয়নের জন্য অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে এই পর্যটন শিল্প।
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ পর্যটন কেন্দ্রে, যা বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে। আমাদের দেশে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত, কক্সবাজার রয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, রয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটিই দেখা যায়। শৈবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, রামুর বৌদ্ধ মন্দির, হিমছড়ির ঝরনা, ইনানী সমুদ্র সৈকত, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওড়, টেকনাফ সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ী অঞ্চল দেখে কেউ কেউ আত্মভোলা হয়ে যায়। আবার আমাদের দেশে অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রতœতাত্ত্বিক স্থানও রয়েছে। বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর মাজার, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী শুধু দেশীয় নয়, বরং বিদেশী পর্যটক ও দর্শনার্থীদের কাছেও সমান জনপ্রিয় এবং সমাদৃত।
পর্যটন শিল্প বিকাশে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বঙ্গবন্ধু এর সঠিক ব্যবস্থাপনার দিকে জোর দেন। তাই পর্যটনকে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অন্যতম উৎসে পরিণত করতে বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন’ প্রতিষ্ঠা করে। তিনি ১৯৭২ সালের ২৭ নবেম্বর ‘বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন’ প্রতিষ্ঠা করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল এই দেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করা। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পর্যটন কর্পোরেশন বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল তিনি সুইজারল্যান্ডের মতো করে বাংলাদেশকে নির্মাণ করবেন। কক্সবাজার বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান। এটি বিশে^র দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল তিনি কক্সবাজারকে এশিয়ার ভিয়েনা হিসেবে তৈরি করবেন। সেই লক্ষ্যে তিনি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঝাউবনের গোড়াপত্তন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি সমুদ্রের অমিত সম্ভাবনাকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে উত্তরণে ১৯৭৪ সালে সমুদ্রসীমা আইন প্রণয়ন করেছিলেন।
১৯৭২ সালের নবেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুয়াকাটা ভ্রমণ করেন। তখন তিনি এর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন। কুয়াকাটাকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করার জন্য তিনি নানামুখী পরিকল্পনা নেন। কিন্তু তিনি তা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ দেশে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এটির প্রসার ঘটাতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক ভাবমূর্তি পাল্টে যাবে।’ কিন্তু সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জন্য এক কলঙ্ক বয়ে আনে।
পর্যটকরা বিভিন্ন দেশের লেখক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজসেবক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্মস্থান ও কর্মময় জীবন অবলোকন করার জন্য ভ্রমণ করে থাকে। আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে মহাত্মা গান্ধী, সাউথ আফ্রিকার নেলসন মেন্ডেলাসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মস্থান ও জীবনী দেখতে পর্যটকরা ভ্রমণ করে থাকে। একইভাবে আমরাও আমাদের দেশের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মময় জীবন সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে পারি। বঙ্গবন্ধুর জীবনী সম্পর্কে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে তা বিশ^বাসীর কাছে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকার ধানম-ির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, যা বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে রয়েছে এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া নিয়ে একটি পর্যটন এলাকা তৈরি করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক জীবন, শৈশব, কারাগারের জীবন সকল ক্ষেত্রে তুলে ধরা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো ‘ডকুমেন্টারি বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে মনোনীত করেছে। এই সকল বিষয় পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বহির্বিশ্বে প্রচারণা চালাতে হবে। জাতির পিতার প্রতিষ্ঠিত সংস্থা বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
পাশাপাশি বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। পর্যটনের জন্য চাই সমন্বিত উদ্যোগ। শুধু বিনোদনই নয়, জীবনের নানা প্রয়োজনে, নানা কারণে আমরা দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে থাকি। প্রকৃতির অপার সম্ভারের মাঝে লুক্কায়িত আছে নানা রহস্য, সৌন্দর্য। সুন্দর অনুপম প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ ও জ্ঞান অন্বেষণে ভ্রমণের বিকল্প নেই। পর্যটন এক্ষেত্রে মানুষের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বাংলাদেশের এ সৌন্দর্য অবলীলায় আকৃষ্ট করবে ভ্রমণপিপাসুদের। জাতির পিতার গৌরবময় ও সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে জানতে পৃথিবীর অনেক দেশের পর্যটক আগ্রহী। এর জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার চালাতে হবে। এর মধ্য দিয়ে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও জীবন সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারবে।
লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়