ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

ধর্ম ॥ নব নব বার্তা

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৬ আগস্ট ২০১৭

ধর্ম ॥ নব নব বার্তা

মধ্যযুগের সাহিত্য পাঠের ক্লাসে শ্রীকৃষ্ণের দুই রূপের আলোচনা হয়। একটি জীবাত্মা বা জাগতিক রূপ অন্যটি পরমাত্মা বা পারলৌকিক রূপ। নন্দনতত্ত্বে কৃষ্ণের জীবাত্মা রূপটিই আদরণীয়। ব্রজের রাখাল কৃষ্ণ। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ননি চুরি করে। বন্ধু সুবলকে সঙ্গে নিয়ে টো টো করে ঘুরে নানান দস্যিপনা করে কাটে তার অলস সময়। কখনও প্রতিবেশী মেয়েদের সঙ্গে দুষ্টুমি, কখনও পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া। আর সবার ওপর রয়েছে রাধার সঙ্গে প্রেম। এই মানবিক কৃষ্ণ সবার প্রিয় ও পরিচিত। কিন্তু একে ছাপিয়ে জাঁকিয়ে বসেছেন পরমাত্মা কৃষ্ণ। এতকাল যিনি শাস্ত্রকার পুরোহিতদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনিই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন চলচ্চিত্র, মিডিয়া জগত। কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া ভারতের এযাবতকালের সেরা ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘বাহুবলী-২’ এ প্রাচীন ভারতের যে জয়গান গাওরা হয়েছে শুরুর দিকে প্রতীকীভাবে বেশ বড় পরিসরে সেখানে রয়েছেন তিনি। ভারতীয় টেলিভিশন সিরিয়ালে তো বহু আগে থেকেই আছেন। তবে বাড়াবাড়িটা সাম্প্রতিক হলেও আন্তর্জাতিকভাবে কৃষ্ণ পুনর্জাগরণের শুরু সম্ভবত গত শতকের নব্বই দশক থেকে। ‘ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস’ (ইসকন)-এর মাধ্যমে। বছর দুয়েক আগে ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে ইসকনের বাংলাদেশ শাখার কিছু সদস্যের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ইসকন সম্পর্কে আগে শুনেছি। এভাবে মুখোমুখি হইনি কখনও। এরা এসেছে কনফারেন্সে। কনফারেন্স না বলে ধর্মসভা বলাই হয়ত বেশি সঙ্গত। কঠোর নিরামিষাশী ইসকন সদস্যদের কিছু শর্ত মানতে হয়। এদের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রাচীন ভারতের বৈদিক শাস্ত্রানুসারে ভগবৎ ভাবনার বা কৃষ্ণভাবনাময় বিজ্ঞান মানব সমাজের কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রচার করা। ‘কৃষ্ণভাবনাময় বিজ্ঞান’ বিষয়টা কি সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেলাম না। ভারত থেকে উনিশ শ’ পঁয়ষট্টি সালে স্বামী প্রভুপাদ এই কৃষ্ণভাবনামৃত নিয়ে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। বোস্টনে অবতরণের পর তিনি ডায়রিতে লিখেছিলেন, ‘আমার প্রিয় কৃষ্ণ, আমি নিশ্চিত যে, যখন এই অপ্রাকৃত বার্তা পশ্চিমাদের হৃদয়ে গেঁথে যাবে, তখন তারা অপ্রাকৃত আনন্দ অনুভব করবে এবং এভাবে তারা সমস্ত দুর্দশাময় জীবন থেকে মুক্তি লাভ করবে। ‘দুর্দশাময় জীবন’ বলতে প্রভুপাদ সম্ভবত ভোগবাদী বাণিজ্যসর্বস্ব সংস্কৃতিকে বুঝিয়েছেন। এ সংস্কৃতিকে লালন করে যে অর্থনৈতিক পদ্ধতি এবং একে দূর করতে হলে যে ওই পদ্ধতিকেই দূর করা দরকার স্বাভাবিকভাবেই প্রভুপাদ সে সব নিয়ে কথা বলেননি। তিনি দুর্দশাময়তার মধ্যে থেকেই ‘অপ্রাকৃত বার্তা পশ্চিমাদের হৃদয়ে গেঁথে’ দিতে চেয়েছেন। এই চাওয়ার প্রভাব কদ্দুর গিয়ে পৌঁছায় ধর্মপ্রচারকদের কাছে তা জানতে না চাওয়াই ভাল। যা হোক, প্রভুপাদ তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছিলেন, মানুষের সৃষ্টি কৃত্রিম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই কিভাবে ভূমির ওপর সরল ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করা যায়। উদাহরণ হিসেবে ছিল পেনসিলভানিয়ার ‘গীতা নগরী।’ গ্রামীণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশে এটি ‘হরে কৃষ্ণ’ কমিউনিটির একটি আশ্রম। প্রভুপাদের বাসনা বাস্তবায়িত করতে উনিশ শ’ তিরানব্বই সালে পাশ্চাত্যের মাটিতে নব ব্রজধাম গড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। স্থান হাঙ্গেরী। বৃন্দাবনের আদলে নির্মিত এই ব্রজধাম বা কৃষ্ণভ্যালীতে কৃষ্ণের কুঞ্জবন তৈরি হয়েছে দু’শ’ হেক্টর জমিতে। এখানে বইছে কৃত্রিম যুমনা, রং-বেরঙের ময়ূর উড়ছে থেকে থেকে। গোকুলের গরু তো চরছেই। গরুর জন্য রয়েছে পাঁচতারা হোটেল। আঠারোটি গরু আর উনিশটি ষাঁড়ের আলয় এই পাঁচতারকা হোটেল নাকি ইউরোপের সেরা গোয়ালঘর। শাড়ি এবং ধুতি পরা সাদা চামড়ার কৃষ্ণ ভক্তরা গরুর ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে চাষবাস করছেন। গরুকে খাওয়াচ্ছেন, সেবা শুশ্রƒষা করছেন। এখানে বিদ্যুত নেই। রান্না এবং ঘর গরম রাখার জন্য ব্রজবাসী ব্যবহার করেন বাগান থেকে সংগ্রহ করা কাঠ। বিগ্রহের রান্নায় ব্যবহার করা হয় গোবর থেকে উৎপাদিত গ্যাস আর কম্পিউটার চালানো হয় কিছু সৌর প্যানেলের বিদ্যুত দিয়ে। নিজেদের পোশাক জুতা ইত্যাদি এরা নিজেরাই তৈরি করে। টেলিভিশন, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি চালানোর কোন অপশন না থাকলেও একটা গোটা কৃত্রিক গ্রাম পরিচালনা করা নিঃসন্দেহে এক দক্ষযজ্ঞ। এর অর্থের যোগান কোত্থেকে আসে তা এক বড় প্রশ্ন। ইসকনের প্রকাশ্য মতানুযায়ী, হাঙ্গেরীতে প্রচলিত একটি বিশেষ আইনে জনগণ তাদের ট্যাক্সের এক ভাগ দান করেন পছন্দের কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীকে। বছরের প্রথম দু’মাসে এ দান করা হয়। ভক্তরা ওই সময় অর্থ সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়েন। হাঙ্গেরীতে হরে কৃষ্ণ আন্দোলন এত জনপ্রিয় যে অর্থ সংগ্রহ খুব সহজেই হয়। এসব বৃত্তান্ত শুনে আর সৈকতের ধর্মযজ্ঞ দেখে রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’র শ্রীবিলাসের কথা মনে পড়ে যায়। শচীন ও শ্রীবিলাস দু’বন্ধু লীলানন্দ স্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর শ্রীবিলাসের মন্তব্য- ‘আমাদের মতো এত বড় দুটো দুর্ধর্ষ ইংরেজীওয়ালা নাস্তিককে দলে জুটাইয়া লীলানন্দ স্বামীর নাম চারদিকে রটিয়া গেল। কলিকাতাবাসী তাঁর ভক্তেরা এবার তাঁকে শহরে আসিয়া বসিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল।’ স্বামী প্রভুপাদ ইউরোপ-আমেরিকা, ভারত-বাংলাদেশের আধুনিক তরুণদের যেভাবে আকৃষ্ট করছেন তাতে তাঁর নামও বিশ্বের পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ছে। আধুনিক জীবনধারায় বেড়ে ওঠা যে তরুণরা তাঁর পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছে তারাও কি শেষে শচীন শ্রীবিলাসের মতো অতিভক্তির মালা ছুড়ে ফেলে জীবনের স্বাভাবিক গতিতে ফিরবে? নাকি তাদের নশ্বর দেহ বাড়বে আধুনিক লাইফস্টাইলে আর মন থাকবে আধ্যাত্মিক জগতের অতীন্দ্রিয়তার খাঁচায় বন্দী পাখি হয়ে? চিন্তা ও কাজের পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান কোন সমাজের জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়। ইসকন সদস্যদের সঙ্গে একবেলা ভালই কাটল। পরদিনের পরিকল্পনা রামুর বৌদ্ধমন্দির দর্শন। বৌদ্ধমন্দির পোড়ানোর পর কক্সবাজারে এসে রামু না যাওয়ার কৌতূহল সামলানো যায় না। গৌতম বুদ্ধর দর্শনের মূল সিদ্ধান্ত চারটি। এক. ঈশ্বরকে অস্বীকার করা। দুই. আত্মাকে নিত্য স্বীকার না করা। তিন. কোন গ্রহকে স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে স্বীকার না করা। চার. জীবন প্রবাহকে এই শরীরের মধ্যেই সীমিত মনে করা। বুদ্ধ একদিকে ভোগাসক্ত জীবনযাপনের বিরোধিতা করেছেন অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় কৃচ্ছ্রয় শরীরকে রুগ্ন করাকে মূর্খতা মনে করতেন। কিন্তু রামুর মন্দিরে প্রথমেই চোখে পড়ে ভক্তের পূজা। কাঁসার পাত্রে ফুল পাতা দূর্বা সাজিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে বুদ্ধ মূর্তিকে প্রণাম করে ভক্তরা জোড় হাতে বুদ্ধ বুদ্ধ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। পুড়ে যাওয়া মন্দিরের জায়গায় নতুন মন্দির উঠছে। সব কিছু ছিমছাম। তারপরও থমথমে ভাব যেন রয়ে গেছে। দর্শনার্থী আসছে যাচ্ছে। মুখরিত পরিবেশই বলা যায়। কিন্তু সব ছাপিয়ে বাতাস যেন কানে কানে বলে কোন এক রহস্যময়তার কথা। মানুষের চিন্তাশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করা, সামাজিক বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য শাসকরা নানা সময়ে নানান কৌশল নিয়েছে। প্রাচীন ভারতের শাসকরাও তাই করেছেন। বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার অভাব দেখে শাসকরা সে সময়ে ব্রহ্মজ্ঞান এবং পুনর্জন্মের দর্শন সৃষ্টি করেছিলেন। সমাজে সম্পত্তি মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং দাস, করিগর ইত্যাদি শ্রমজীবী শ্রেণীকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, নিষ্পেশন ও পদদলিত করে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে অনড় রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো। বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন মূলত এর বিরোধিতা করে বিকশিত হয়েছিল। বিশ্ব জগতের সবকিছুকেই এ দর্শন পরিবর্তনশীল বলেছে। মানুষকে সময়ানুয়ায়ী পরিবর্তিত হতে এবং যে কোন সামাজিক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলেছে। তুলনাটা বেশ মজার। একটি ধর্ম বৈদিক ধর্মের প্রতিবাদ করে বিশ্বের এক বড় সংখ্যক ধর্ম বিশ্বাসীর আস্থা অর্জন করেছে। অন্যটি বিজ্ঞান প্রযুক্তির চরম বিকশিত এই যুগে বৈদিক সমাজে ফিরতে চাইছে।
×