
কোনো পদ্ধতিই কাজে আসছেনা মশা নিধনে।
রাজধানী ঢাকায় মশার উৎপাত এতটাই বেড়েছে যে ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। শুধু রাতে নয়, দিনেও মশার কামড়ে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। রাজধানীর মশা নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে শুধু ঢাকাতেই মশা বেড়েছে দ্বিগুণ।
শীত শেষে নেই জমে থাকা পানি, বছরে মশা মারার পেছনে ব্যয় হচ্ছে শত কোটিরও বেশি টাকা। তারপরও কেনো মশা বাড়ছে?
এমন পরিস্থিতিতে মশাবাহী রোগ প্রতিরোধে গত মঙ্গলবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সিটি করপোরেশনের প্রতি অনুরোধ জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন। বৈঠকে ঢাকার উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) নিয়ে। তিনি বলেন, ‘ঢাকার খালগুলো পরিষ্কারের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউক এটি পরিষ্কার না করার কারণেই মশা বাড়ছে।’
মশা নিয়ে সম্প্রতি যে গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মশা রয়েছে রাজধানীর উত্তরা ও দক্ষিণখানে। যার দুটিই পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে।
এর আগে মশা নিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ভেজাল কোম্পানির কাছ থেকে কীটনাশক ‘বিটিআই’ আমদানি করায় ওই সিটির মশা মারার উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, গত কয়েক বছরে মশা মারতে দুই সিটি করপোরেশনের ব্যয় হয়েছে কয়েকশ কোটি টাকা।
ব্যবহার করা হয়েছে ড্রোন। পানিতে ছাড়া হয়েছে ব্যাঙ, হাঁস, তেলাপিয়া ও গাপ্পি মাছ। কিন্ত এত কিছুর পরও মশা না কমে কেন বেড়েছে, এর কোনো উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছেও নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘মশা এখন যন্ত্রণাদায়ক ও বিরক্তিকর একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগকে বিশেষভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আশা করি আমাদের উদ্যোগগুলো কাজে লাগবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলবায়ুর পরিবর্তন ও মশা নিধনে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে দিন দিন মশা বাড়ছে।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলছেন, ‘সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া উদ্যোগ নিলে মশা কখনওই কমবে না। তাছাড়া কিউলেক্স আর এডিস মশা নিধনে নিতে হবে আলাদা উদ্যোগ।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘ঢাকা সিটির খাল ও জলাশয়গুলোতে অনেক মশা জন্ম নেয়। এসব খালের নিয়ন্ত্রণ রাজউক, ওয়াসা-সহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে থাকায় সেগুলো অপরিচ্ছন্ন থাকে। যে কারণে মশা অনেক বৃদ্ধি পায়।’
ঢাকার যাত্রাবাড়ি, উত্তরা, মিরপুর, দক্ষিণখান ও সাভারের কয়েকটি জায়গায় মোট ১২টি ফাঁদ পাতেন মশা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কবিরুল বাশারের নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল। প্রতি ২৪ ঘণ্টা পরপর ফাঁদের মশা পরীক্ষা করেন এই দলটি। ফাঁদে জমা মশা নিয়ে এই দলটি গত পাঁচ মাসের একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, এই ফাঁদগুলোতে গত বছরের নভেম্বর মাসে গড়ে প্রতিদিন ২০০টি করে, ডিসেম্বরে ২২৩টি, জানুয়ারিতে ৩০০টি, ফেব্রুয়ারি ৩৩৮ এবং মার্চে ৪২০টি করে মশা ধরা পড়েছে।
সেই হিসাব অনুযায়ী, তিন মাসের মধ্যে ঢাকায় মশা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সবগুলো ফাঁদে আটকা পড়া মশার গড় সংখ্যা ৪২০টি হলেও উত্তরা এবং দক্ষিণখানের চারটি ফাঁদে দৈনিক ধরা পড়ে গড়ে ৬০০টি মশা।
ভেতর ও বাইরে আলাদা দুটি ফাঁদে সপ্তাহে একবার করে মাসে চারবার মশা সংগ্রহ করে হিসাব করে গড় বের করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দলটি বলছে, ফাঁদে যে সব মশা আটকা পড়েছে তার মধ্যে ৯৯ ভাগই ছিল কিউলেক্স মশা।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, ‘গত বছরের তুলনায় এই সময়ে মশা বেড়েছে কি না তা তুলনা করার জন্য কোনও পরিসংখ্যান আমার কাছে ছিল না। সেটি করার জন্যই আমরা এই গবেষণাটি করেছিলাম। এভাবে ফাঁদ পেতে তারা মূলত দেখতে চেয়েছেন কোন প্রজাতির মশা কখন বাড়ছে, আবার কখন কমছে।’এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ অবশ্য এই গবেষণা মানতে নারাজ। দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ওনারা কী গবেষণা করেছেন সেটা ওনাদের নিজস্ব বিষয়। এই গবেষণার সাথে আমি একমত নই। কারণ আমরা মনে করি দক্ষিণ সিটিতে মশা নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে।’
গত কয়েক বছরে মশা মারতে একের পর এক উদ্যোগ নেওয়া হলেও এসব উদ্যোগের কোনওটিই কাজে লাগেনি। পরে সে সব উদ্যোগ থেকে পিছু হাটতে হয়। মশা মারতে সিটি করপোরেশনের লেক কিংবা পানিতে প্রথম গাপ্পি মাছ ছাড়া হয় ২০১৭-১৮ সালের দিকে। তখন সিটি করপোরেশন ও কীটতত্ত্ববিদরা বলেছিলেন, গাপ্পি মাছ মশার লার্ভা নিধনে সবচেয়ে কার্যকরী।
ঢাকার ড্রেন ও জলাশয়ে গাপ্পি মাছ ছাড়ার কিছুদিন পর সেগুলোর অধিকাংশই মারা যায়। এ নিয়ে সমালোচনাও তৈরি হয়। পরবর্তীতে ঢাকার মশার লার্ভা নিধনে ঢাকার বিভিন্ন জলাশয়ে ছাড়া হয় পাঁচশোরও বেশি হাঁস। কোথাও কোথাও ছাড়া হয় তেলাপিয়া মাছ। এমনকি ব্যাঙও ছাড়া হয় অনেক জলাশয়ে। তেলাপিয়া আর গাপ্পি মাছ ঢাকার দুই সিটিতেই ছাড়া হলেও, হাঁস অবমুক্ত করা হয়েছিলো শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটির দশটি অঞ্চলে। কিন্তু কিছুদিনের মাথায় সেই হাসগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক জায়গায় মারা যায় মাছ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘আমরা যে সব জায়গাগুলোতে মাছ-ব্যাঙ ছেড়েছিলাম সেগুলোতে পরে আর কোনও লার্ভা পাওয়া যায়নি। তবে কিছু কিছু জায়গা থেকে আমাদের হাঁস মিসিং হয়েছে। তবে এসব পদ্ধতিতে ভালো ফলাফল পেয়েছি আমরা।’
তবে এসব পদ্ধতি কেন কাজে আসেনি সেটা নিয়েও নানা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। তারা বলছেন, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও দায়সারাভাবে কীটনাশক ছিটানোর কারণে অনেক সময় কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায় না।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলছেন, ‘গাপ্পি মাছ অনেকটাই কার্যকরী। তবে অনেক সময় মশা মারতে অনেক লেক ও জলাশয়ে কীটনাশক ও পোড়া মবিল দেওয়া হয়। এগুলোর কারণে সিটি করপোরেশনের ছাড়া গাপ্পি ও অন্য মাছ মরে যায়। যা হয় হিতে বিপরীত।’
মশা মারতে আরো অত্যধিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। মশার ওষুধ ছেটাতে তারা তারা ড্রোন ব্যবহার করে ২০২১ সাল থেকে। কিন্তু পরবর্তীতে কার্যকর ফলাফল না পাওয়ার কারণে সেই পদ্ধতি থেকে সরে আসে উত্তর সিটি।
উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘ড্রোন দিয়ে মশা মারার যে ওষুধ ছিটানো হয় সেটা আসলে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সেই সাথে এভাবে ওষুধ ছিটানোর ফলাফল খুব একটা কাজে আসে না। এ জন্য আমরা সে উদ্যোগ থেকে সরে এসেছি।’
এমন অবস্থায় সামনেই আসছে বর্ষাকাল। নানা কারণে মশা বেড়েছে। বর্ষা মৌসুমে নতুন করে ডেঙ্গু বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা।
সূত্র: বিবিসি।
এম হাসান