স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে বাংলাদেশী তরুণীকে নির্যাতনের ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে টিকটক হৃদয় বাবুর সহযোগী হিসেবে ছিলেন আলামিন নামে যশোরের এক যুবকও। তার বাড়ি যশোর শহরের চাঁচড়া মধ্যপাড়া এলাকায়। ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর শহরটিতে তোলপাড় চলছে। আলামিনের পরিবারের দাবি, আট মাস আগে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। স্থানীয় পুলিশও বিষয়টি নিয়ে খোঁজ-খবর করেছে। নির্যাতনকারী চক্রটির ব্যাপারেও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, ২১ মে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে বাংলাদেশী এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। নির্যাতনে জড়িত অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার সবাই একই গ্রুপের এবং সবাই বাংলাদেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি প্রচার হওয়ার পর নির্যাতনের শিকার তরুণীর বাবা ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার ও পর্ণোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। তরুণীকে পাচার করার মূলহোতা টিকটক হৃদয় বাবু বলে জানা গেছে। এছাড়া নির্যাতনের ভিডিওতে হৃদয় বাবুর সহযোগী হিসেবে আলামিনও শনাক্ত হন। আলামিনের বাবা ভ্যানচালক মনু মিয়া বলেন, ‘আলামিন ও তার বউ শারমিন (দ্বিতীয় স্ত্রী) ভাল না। বাড়ি বসে ইয়াবা সেবন করত। তার বাসায় বাইরের লোক আসতো। তাই আট মাস আগে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। শুনেছি আলামিন ভারতে গেছে, তার বউ বাপের বাড়ি। সেখানে সে কি করছে জানি না, তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই।’ স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আগে থেকেই বেপরোয়া আলামিন দেশে দুটি বিয়ে করেছে। দুই সংসারে তার দুটি সন্তান রয়েছে। তাদের ফেলে সে ভারতে চলে যায়। ভিডিওতে সে গোলাপি ফুলহাতা গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট পরিহিত এবং তার পায়ে কালো রাবারের ব্যান্ড রয়েছে। ভিডিওতে থাকা লাল ফুলহাতা টপস পরা মেয়েটির নাম তানিয়া। তানিয়ার বাড়ি যশোরের নওয়াপাড়ায়। তানিয়াকে আলামিন স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভারতে নিয়ে গেছে। আলামিন বা তানিয়ার কেউই এখনও আটক হয়নি। তারা ওই এলাকায় পালিয়ে রয়েছে। এদিকে ভারতের একটি সূত্র জানিয়েছে, টিকটক হৃদয় বাবু, আলামিনসহ চক্রটি ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর কোর্টলোর এলাকায় থাকে। সেখানে ‘রাফি’ নামে একজনের আস্তানা রয়েছে। এই রাফির বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা এলাকায়। তার প্রকৃত নাম আশরাফুল মন্ডল। রাফিকে আলামিনরা বস বলে সম্বোধন করে। গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর আলামিন তানিয়াকে নিয়ে অবৈধপথে বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। যাওয়ার আগে সে চাঁচড়া এলাকার ইয়াবা বিক্রেতা কামরুলের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকার ইয়াবা কিনে নিয়ে যায়। ‘অরিজিনাল মাল’ হিসেবে মাদকাসক্ত ‘রাফিকে’ উপহার দেয়ার জন্য এই ইয়াবা তিনি ব্যাঙ্গালুরু নিয়ে গেছেন। ভারতের সূত্রটি আরও জানায়, নির্যাতনে জড়িত আলামিন ও তানিয়া গা ঢাকা দিয়েছে। এছাড়া ডালিম ও সবুজ নামে আরও দুই যুবক ছিল, তারাও পালিয়ে গেছে। ব্যাঙ্গালুরু পুলিশ তাদের খুঁজছে। ভাইরাল ভিডিও নিয়ে কথা হয় চাঁচড়া মধ্যপাড়া এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। তারা জানান, এলাকায় এটি জানাজানি হওয়ার পর অনেকে আলামিনের পরিবারের সদস্যদেরও বিষয়টি জানিয়েছেন। এটি নিয়ে বাড়ির লোকজন চাপের মধ্যে রয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় চাঁচড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক রকিবুজ্জামান বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ জানান। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) বেলাল হোসাইন জানান, ভারতে তরুণী নির্যাতনের ভিডিও ভাইরালের ঘটনা তিনি জানেন। ওই ঘটনায় জড়িত কারও বাড়ি যশোরে এমন তথ্য এখন তারা পাননি। তবে বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।
পাঁচ বাংলাদেশীর সবাই অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছিল ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, ভারতে তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত পাঁচ জন বাংলাদেশীর সবাই অবৈধভাবে সেখানে গিয়েছিল। তাদের কারও পাসপোর্ট কিংবা ভিসা ছিল না। শনিবার বিকেলে রাজধানীর শ্যামলীতে নিজ কার্যালয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোঃ শহিদুল্লাহ এসব তথ্য জানান। এদিকে ভারতে নারী নির্যাতনের এই ঘটনার পর পুলিশ এ ধরনের একটি বড় চক্রের সন্ধান পেয়েছে। ফেসবুক কেন্দ্রিক এই চক্রটি ধরার জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক টিম মাঠে নেমেছে।
গ্রুপের পার্টি ॥ তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, টিকটকের মাধ্যমে পরিচিত হওয়া তরুণ-তরুণীদের নিয়ে মানবপাচারকারী চক্রের একটি গ্রুপ পরিচালনার তথ্য পেয়েছে। যে গ্রুপের এ্যাডমিন ও পৃষ্ঠপোষক ওই আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রটি। একটি গ্রুপের এ্যাডমিনের তত্ত্বাবধানে গত বছরের শেষের দিকে ঢাকার পাশের একটি জেলায় পুলপার্টিও আয়োজন করা হয়। ওই পার্টিতে প্রায় ৭০০-৮০০ তরুণ-তরুণী অংশ নেয়। এ গ্রুপ থেকেই নারীদের টার্গেট করে বিভিন্ন মার্কেট, সুপার শপ, বিউটি পার্লারে ভাল বেতনে চাকরির প্রলোভনে পাচার করা হয়।
আগে অনেককে পাচার হয়েছে ॥ ভারতের ওই তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে এ চক্রের মাধ্যমে আরও অনেক তরুণীকে পাচারের তথ্য পেয়েছে মামলা তদন্তসংশ্লিষ্টরা। সঠিক সংখ্যা এখনও নিশ্চিত না হলেও এটি নেহাত কম নয় বলে মনে করছেন তারা। তারা বলছেন, এমন আরও গ্রুপ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পাচার নারীদের জোর করে পতিতাবৃত্তি করা হচ্ছে ॥ ভারতে এ চক্রটির মূল আস্তানা ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায়। মূলত দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত করতেই বিভিন্ন বয়সীদের ভারতে পাচার করা হয়। তাদের সঙ্গে সেখানকার স্থানীয় কিছু হোটেলে চুক্তি থাকে। সে অনুযায়ী তারা টাকার বিনিময়ে তরুণীদের সরবরাহ করে। পাচার হওয়া তরুণীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করতে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে বিবস্ত্র করে ছবি তোলা ও ভিডিও করা হয়। শারীরিক নির্যাতনও করা হয়। তাদের কথা মতো অনৈতিক কাজ করতে রাজি না হলে ছবি-ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। তাদের হাতে রাখতে এবং বাধ্যতামূলকভাবে অনৈতিক কাজ করাতে এটা ব্ল্যাকমেলিংয়ের কৌশল।