ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

আমির আব্দুল্লাহিয়ান: ইরানের নিভে যাওয়া এক লাইটহাউস

মোঃ মিজানুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ১৮ জুন ২০২৫; আপডেট: ১০:০৩, ১৮ জুন ২০২৫

আমির আব্দুল্লাহিয়ান: ইরানের নিভে যাওয়া এক লাইটহাউস

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব কূটনীতির বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে কখনো কখনো এমন কিছু বিরল ব্যক্তিত্ব আবির্ভূত হন, যাঁরা আলোয় নয়—নিঃশব্দতার গভীরতায় ইতিহাস গড়েন। দৃঢ় নৈতিকতা, পরিশীলিত বাস্তববোধ ও অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে তাঁরা নেতৃত্ব দেন, যাঁদের হাতে কূটনীতি হয়ে ওঠে শুধু রাষ্ট্রীয় নয়, এক গভীর মানবিক দর্শনের প্রকাশ। তেমনই এক অসাধারণ আলোকবর্তিকা ছিলেন ইরানের প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান। তিনি ছিলেন পর্দার আড়ালের সেই স্থপতি, যিনি নিভৃতে জ্বালিয়েছেন অন্ধকার সময়ের দীপ্ত আলোকশিখা। ভূরাজনৈতিক ঘূর্ণিপাক, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী হিমশীতল চাপ, অর্থনৈতিক অবরোধ আর অস্ত্রনির্ভর হুমকির মধ্যেও আব্দুল্লাহিয়ান ছিলেন ইরানের আত্মমর্যাদার অবিচল প্রহরী। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সুগভীর বিশ্লেষণী দৃষ্টি ও পরিশীলিত কূটনৈতিক ব্যাকরণ ইরানের পররাষ্ট্রনীতিকে দিয়েছিল নতুন গতি, নতুন ব্যঞ্জনা।

তিনি ছিলেন উচ্চারণের চেয়ে উপলব্ধির রাষ্ট্রনায়ক; বক্তৃতার চেয়ে প্রয়োগে বিশ্বাসী এক নিরব সাহসী। তাঁর নেতৃত্বে ইরানের কূটনীতি পেয়েছিল এক গভীরতা, যেখানে আদর্শ ও কৌশলের অনন্য সংমিশ্রণে নির্মিত হয়েছে প্রতিরোধের পথ, সমঝোতার সেতু এবং আত্মমর্যাদার দুর্ভেদ্য দুর্গ। তার কূটনীতি ছিল প্র্যাগম্যাটিজম, প্রজ্ঞা এবং দৃঢ়তার এক নিখুঁত সংমিশ্রণ।

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পর তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া বিষয়ে একজন গভীর পর্যবেক্ষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। রাজনীতির ছাত্র এবং পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজের দক্ষতা গড়েছিলেন ধাপে ধাপে।

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মঞ্চে শান্তির খোঁজে
মধ্যপ্রাচ্য হলো এমন একটি ভৌগোলিক ক্ষেত্র যেখানে যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব, জোট এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিত্যদিনের ঘটনা। এমন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় আব্দুল্লাহিয়ান ছিলেন এক ব্যতিক্রমী সত্তা। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ইরান-সৌদি আরব সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে। এক দশকের উত্তেজনার পর চীনের মধ্যস্থতায় ২০২৩ সালে দুই দেশের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের রূপরেখা তৈরি হয়। আব্দুল্লাহিয়ান এর অন্যতম রূপকার ছিলেন। তিনি রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যকার দীর্ঘ শীতলতা ভেঙে একটি যৌথ সমঝোতার পথে পৌঁছাতে সক্ষম হন—যা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। পারমাণবিক আলোচনায়ও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জটিল কূটনৈতিক টানাপোড়েনে ইরানের অবস্থানকে দৃঢ় রাখেন, সরাসরি সংঘর্ষে না গিয়ে চূড়ান্ত কৌশলে সমঝোতার জায়গা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যান।

"লুক ইস্ট" কৌশল: পাশ্চাত্য নির্ভরতা থেকে বের হওয়ার রোডম্যাপ
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প খোঁজার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা থেকেই তিনি “লুক ইস্ট পলিসি” চালু করেন। এই কৌশলের মূলে ছিল — চীন, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আর আন্তর্জাতিক চাপ ইরানের কূটনীতি ও অর্থনীতিকে জিম্মি করতে না পারে। চীনের সঙ্গে ২৫ বছরের কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি, রাশিয়ার সঙ্গে শক্তিধর সামরিক ও জ্বালানি চুক্তি এবং মধ্য এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে পুনর্মিলনের ভিত্তি—সবই ছিল এই দর্শনের ফল।

সামরিক সহযোগিতা এবং বুদ্ধির মিশেল
হামাস, হিজবুল্লাহ, হুথি এবং অন্যান্য প্রতিরোধ সংগঠনের পেছনে কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা সহায়তা প্রদান করে ইসরায়েলকে নিত্যদিন চাপে রেখেছিলেন আব্দুল্লাহিয়ান। কিন্তু একে একক প্রয়াস বলা ভুল হবে—এই ভূমিকায় তিনি ছিলেন আইআরজিসি জেনারেলদের সুশৃঙ্খল কূটনৈতিক পার্টনার। কাসেম সোলাইমানি এবং পরে ইসমাইল ক্বাআনীর সঙ্গে তার সমন্বয় ছিল নজিরবিহীন। তিনি সামরিক বলয়ের সাথে একটি সুষম কূটনৈতিক তির্যক তৈরি করেছিলেন, যার মাধ্যমে তেলআবিবের চিন্তার রেখা দিনে দিনে দীর্ঘতর হয়েছে।

যুদ্ধ নয় সংগঠনই তার পছন্দের কৌশল
একজন দক্ষ ব্যুরোক্র্যাট হিসেবে তিনি সবসময় রাষ্ট্রের কাঠামোকে শক্তিশালী করতে চেয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের ভিতর নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ বিভাগের মধ্যে সমন্বয়, এবং তথ্যভিত্তিক নীতিনির্ধারণে তার জোর ছিল দৃশ্যমান। আন্তর্জাতিক সফরে তিনি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে বহুবার প্রমাণ করেছেন—শান্ত সংলাপের মাধ্যমে কঠিন সংকটও সমাধানযোগ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, “বলার ভাষা থাকলে গুলির প্রয়োজন পড়ে না”। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েনা পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) নিয়ে আলোচনায় তার ভূমিকা ছিল জটিল ও সংযত। তিনি সবসময় ইরানের সার্বভৌম অধিকার ও স্বার্থকে অক্ষুন্ন রেখে আলোচনার টেবিলে বসেছেন। তার নেতৃত্বে ইরান কেবলমাত্র পশ্চিমা বলয়ের চাপ নয়, বরং চীন, রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে এক বিকল্প কূটনৈতিক বলয় গড়ে তুলেছে।

প্রতিবেশী কূটনীতি; দ্বন্দ্ব নয়, দূরত্ব ঘোচানোর চর্চা
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ইরানের অগ্রগতি সম্ভব নয়। সে কারণেই তিনি সৌদি আরব, আজারবাইজান ও এমনকি তালেবান সরকারের সাথেও সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। চীনের মধ্যস্থতায় ইরান-সৌদি সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ইতিহাস গড়ার পর তাকে বলা হচ্ছিল “মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতার স্থপতি”। তুরস্ক-ইরান-সৌদির ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের সাহস ও বাস্তবায়নও তার রাজনৈতিক পরিণতির প্রমাণ। বহু পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তি তৈরি করেও তিনি কখনও নতি স্বীকার করেননি। ২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসার পর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ইরান ছিল অন্যতম যে রাষ্ট্র কৌশলগত স্থিরতা বজায় রেখেছিল। আব্দুল্লাহিয়ান এই বিষয়ে অতি সংবেদনশীল ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। তিনি আফগানিস্তানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অংশগ্রহণমূলক সরকার গঠনের পক্ষে অবস্থান নেন।

কূটনীতির ‘ছায়া-সৈনিক’
প্রথাগত ভাষণ বা চমকপ্রদ বিবৃতির চেয়ে আব্দুল্লাহিয়ান পছন্দ করতেন ‘কর্মনির্ভর কূটনীতি’। মিডিয়ায় খুব বেশি না থাকলেও তিনি সক্রিয় ছিলেন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বৈঠকগুলোতে। তার সময়েই ইরান সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO) ও ব্রিকস–এর মতো বহুপাক্ষিক সংগঠনে অংশগ্রহণ বাড়ায়। তিনি কূটনৈতিক ব্যালান্স তৈরিতে ছিলেন এক দক্ষ নাবিক।

চিরঞ্জীব হয়ে থাকা এক প্রদীপ
২০২৪ সালে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও আব্দুল্লাহিয়ানসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা নিহত হন। সাথে সাথে নিভে গেছে সেই লাইটহাউস, যে আলো দেখাতো উত্তাল কূটনৈতিক সমুদ্রেও। কিন্তু তার রেখে যাওয়া দর্শন, কৌশল ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আজও দিকনির্দেশনা দেয় ভবিষ্যৎ কূটনীতিকদের। তিনি ছিলেন এক "সিস্টেমিক থিংকার", যিনি একা নয়—সার্বিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়েই কূটনীতি সাজাতেন।

আজ যখন ফিলিস্তিনের রক্ত ঝরে, গাজার শিশুদের কান্না বিশ্বকে নাড়া দেয়, তখন আমির আব্দুল্লাহিয়ানের মতো কণ্ঠগুলো আরও বেশি করে প্রয়োজন পড়ে। এই অকালপ্রয়াণ শুধু ইরানের জন্য নয়, বরং পুরো অঞ্চলের জন্য এক গভীর শূন্যতা তৈরি করেছে। তিনি হয়তো তেমন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন না, কিন্তু কূটনৈতিক জগতে তিনি ছিলেন ছায়ার মতো নিরব, অথচ অদৃশ্য নেতৃত্বের প্রতীক।

মুমু ২

×