ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

কাঁচের চুড়িই মন চুরি করেছে বাঙালী নারীর

প্রকাশিত: ১১:০৫, ১৭ জুলাই ২০১৯

কাঁচের চুড়িই মন চুরি করেছে বাঙালী নারীর

কাঁচের চুড়ি ভাঙ্গার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হয়,/দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি...। সুনীল লিখেছিলেন। তবে নিয়ম কানুন ভাঙ্গা অত সহজ নয়। চুড়ি ভেঙে যায় যখন তখন। দামেও কম। এর পরও কাঁচের চুড়িই মন চুরি করেছে বাঙালী নারীর। গ্রামীণ নারীরা দু’হাত ভরে চুড়ি পরতে ভালবাসেন। আবহমানকাল ধরেই চলে আসছে এ সংস্কৃতি। বাদ যায়নি ঢাকাও। শহুরে নারীরা হাতে ব্রেসলেট প্যাঁচিয়ে নেন। ঘড়ি পরেন। কিন্তু চুড়ির আলাদা আবেদন। চুড়ির সঙ্গে ভেতরটাও বেজে ওঠে। আর তাই রাস্তার ধারে পসরা সাজাতে দেখে ওয়েস্টার্ন জামা-জুতো পরা মেয়েটিও একবার থামে। সামনে হয়ত কোন উৎসব-অনুষ্ঠান আছে, সেদিন শাড়ি পরবে। রং মিলিয়ে পরবে চুড়িও। এমন চিন্তা থেকে অনেকেই কিনে নিয়ে যায়। শৌখিন নারীদের কেউ কেউ আবার চুড়ি জমিয়ে রাখেন। আছে বড় সংগ্রহ। এক সময় বাড়ির বউ-ঝিরা বাইরে তেমন যেতে পারতেন না। গ্রামের হাটে, বৈশাখী বা চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় গিয়ে কেনাকাটা করার সুযোগ তাদের কম হতো। তাই ঝুড়িভর্তি চুড়ি নিয়ে আসা নারী বিক্রেতাদের ডাক কানে আসতেই দৌড়ে ঘর থেকে বের হতেন। ছোট্ট ঝুড়িতে কায়দা করে অনেক চুড়ি রাখা হতো। সেখান থেকে পছন্দ করে, দামদর করে চুড়ি কিনতেন। ঢাকায়ও ফেরি করে চুড়ি বিক্রির দৃশ্য কম দেখা যায়নি। তবে এখন ছবিটা বদলে গেছে। বিশেষ বিশেষ দিনে খোলা জায়গা বা ফুটপাথে পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। আর সারাবছরই চুড়ি পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বর্তমানে কাঁচের চুড়ির সবচেয়ে জমজমাট মেলা বা হাটটি বসছে টিএসসি এলাকায়। চারুকলা অনুষদের সামনে, মেয়েদের হলে আসা যাওয়ার পথে, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে চুড়ি নিয়ে অনেকেই বসেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণেও পাওয়া যায়। তবে টিএসসির ছবিটা একেবারেই অন্যরকম। যারপরনাই রঙিন। একটা উৎসব আমেজ লেগে থাকে। কেনার সুযোগ। দেখতেও ভীষণ ভাললাগে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত তিন-চার বছরে মেলাটি বেশ জমে উঠেছে। এ সময়ের মধ্যে বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার্থী, প্রশাসন ও ঘুরতে আসা মানুষজনের অঘোষিত সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন বিক্রেতারা। বর্তমানে টিএসসি ও আশপাশের এলাকায় ২০ থেকে ২৫টির মতো দোকান রয়েছে। চকবাজার থেকে চুড়ি এনে এখানে বিক্রি করেন তারা। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাথের ওপর, এমনকি মূল রাস্তার পাশে দোকান সাজিয়ে বসেছেন নারী বিক্রেতারা। প্রত্যেকে কমপক্ষে দুটি করে বড় ডালা খুলে রেখেছেন। সেখানে কত রকমের চুড়ি! এত এত রং যে, আকৃষ্ট না হয়ে পারা যায় না। মেয়েরা আসা-যাওয়ার পথে চুড়ি দেখছেন। চুড়ি পরিয়ে দেয়ার দৃশ্যটি ততোধিক সুন্দর। অদ্ভুত মায়ায়-যতেœ চুড়ি পরিয়ে দেয়া হচ্ছে! সাজিয়ে রাখা চুড়ির সবই প্রায় কাঁচের। রেশমি চুড়ির কথা আলাদা করে বলতে হয়। দেখতে সাদামাটা। কিন্তু এ চুড়িতে কী যেন আছে। সেই গানটির কথাই ধরা যাকÑ কিনে দে রেশমি চুড়ি,/নইলে যাব বাপের বাড়ি...। ভাবা যায়? রেশমি চুড়ি কিনে না দিলে বউ অভিমান করে বাপের বাড়ি চলে যেত! দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখনও বিয়েতে নাকি রেশমি চুড়ি চাই। না হলেই নয়। এক ডজন রেশমি চুড়ি পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। অন্যান্য জাতের মধ্যে রয়েছে সুতার চুড়ি, কাটিং চুড়ি, চুমকি চুড়ি, ম্যাটাল চুড়ি, জরি চুড়ি। নামের চেয়েও বেশি আকর্ষণ করে রং। কোন কোন রঙের চুড়ি পাওয়া যায়? সব রঙের। আছে মাল্টিকালার চুড়িও। যার যেমন পছন্দ, কিনছেন। বিকেলে টিএসসি থেকে বের হওয়ার সময় চুড়ি দেখছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী হৃদি। ভাল সময় ব্যয় করলেন। পছন্দ করে চার ডজন চুড়ি কিনলেন তিনি। কিন্তু হাতে তো কোন চুড়ি দেখা যাচ্ছে না। তাহলে এগুলো কিনে কী হবে? জানতে চাইলে তিনি বললেন, যেদিন শাড়িতে সেজে বের হই সেদিন চুড়ি পরি। এ জন্য অনেক কাঁচের চুড়ি জমিয়ে রেখেছেন বলেও জানান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনিমার সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে বন্ধুটিও। চুড়ি পছন্দে সহযোগিতা করছিলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে বললেন, চুড়ি পরতে দেখলে আমার নিজেরও ভাল লাগে। এ কারণেই একটু সহযোগিতা করছি। দৃশ্যটি দূর থেকে দেখছিল আরেকদল মেয়ে। চুড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের একজন আফসোসের ভঙ্গি করে বললেন, আমার ছেলে বন্ধু নেই রে। থাকলে আমাকেও চুড়ি কিনে দিত, বুঝলি? চুড়ি পরিয়ে দেয়ার সময় মেয়েদের কাউকে ‘মা’, কাউকে ‘বইন’ কিংবা ‘খালা’ সম্বোধন করছিলেন বিক্রেতারা। বলছিলেন, ‘একটু নরম করেন হাতটা।’ মেয়েরাও চুড়ি পরতে পরতে একইভাবে বলছিল, ‘না গো খালা, দাম কম রাখ।’ জানতে চাইছিল, ‘আপা, রং থাকবে তো?’ এমন আন্তরিকতা চুড়ি ছাড়া আর কিছু কেনার সময় দেখা যায় না। যায়? এমনকি ছেলেরা চুড়ি কিনতে আসলে যার জন্য চুড়ি কেনা তার হাতের মাপ অনুমান করে বলে দিচ্ছিলেন অভিজ্ঞ বিক্রেতারা। বিক্রেতাদের একজনের নাম রাবেদা। দেখতে প্রবীণ। থাকেন কামরাঙ্গীরচরে। বললেন, ‘এইটা আমার বাপ-দাদার পেশা। মা চুরি বিক্রি করতো। পরে আমি এই ব্যবসায় আইছি। আগে চুড়ি নিয়া পাড়া মহল্লায় ঘুইরা বিক্রি করতাম। এখন বয়স হইছে। শইলে কুলায় না। এইখানে বসি।’ তিনি জানান, পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বরের মতো বিশেষ দিনগুলোতে তারা এই এলাকায় চুড়ি বিক্রি করতে আসতেন। আসতে আসতেই এখানে স্থায়ী হয়েছেন। আরেক বিক্রেতার নাম হাসিনা। মূল বাড়ি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ। কথা প্রসঙ্গে জানান, তার শাশুড়ি ফেরি করে চুড়ি বিক্রি করতেন। এখন নিজে করছেন। এক সময় চাল, মুরগির ডিম ইত্যাদির বিনিময়ে চুড়ি বিক্রি করেছেন বলেও জানান তিনি। এখন শুধু টিএসসিতে বিক্রি করেন। বিশেষ দিনে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার চুড়ি বিক্রি করেছেন বলেও জানান তিনি। সাধারণ দিনে সেই তুলনায় অনেক কম। তবে বিক্রি হয়। তিনি জানান, ক্যাম্পাসের মেয়েরা তাদের মূল কাস্টমার। পরীক্ষা দিতে আসা বা বেড়াতে আসা নারীরা আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে চুড়ি কেনে। অপেক্ষাকৃত কম বয়স রাজিয়ার। বসছেন দুই বছর ধরে। বললেন, ‘এইখানেই মা-খালারা বইত। এহন আমি বসছি। সব ধরনের চুড়ি পাইবেন আমার কাছে।’ কিন্তু দুই হাতে এত চুড়ি কী করে পরবে? জানতে চাইলে পিপলি নামের এক বিক্রেতা বলেন, ‘এক হাতে দুই ডজন চুড়ি পরা যায়। দুই হাতে পরা যায় চাইর ডজন। তাইলে বুঝেন।’ এখানেই শেষনয়। দোকানিরা জানান, অনেকে তাদের বিয়েবাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে সব ধরনের চুড়ি সাজিয়ে বসেন তারা। ভাল বিক্রি হয়। আলাদা বকশিসও মেলে। কেউ কেউ জানালেন, বিয়েবাড়ি থেকে শাড়িও উপহার পান তারা। এভাবে মোটামুটি চলে যাচ্ছে।
×