ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

এবার দেশজুড়ে ভেজাল ইয়াবা কারখানা গড়ে ওঠার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ১০:৪০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

এবার দেশজুড়ে ভেজাল ইয়াবা কারখানা গড়ে ওঠার আশঙ্কা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ শতাধিক চিহ্নিত ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পণের পর দেশের ভেতরে ‘ভেজাল ইয়াবা’ তৈরির কারখানা গড়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইয়াবার বিকল্প হিসেবে মাদক ব্যবসায়ীরা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ফেনসিডিল এনে দেশের ভেতরে ছড়িয়ে দিতে পারে। আর ফেনসিডিলের বিকল্প হিসেবে কাশির সিরাপ ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমন আশঙ্কা থেকেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশে যাতে ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠতে না পারে, সীমান্তপথে যাতে ফেনসিডিল না আসতে পারে এজন্য কড়া নির্দেশ জারি করেছে। নির্দেশনা মোতাবেক মাদকবিরোধী চলমান অভিযানে শুক্রবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পাথর বোঝাই ট্রাকে করে পাচারের সময় প্রায় নয় শ’ বোতল ফেনসিডিলসহ র‌্যাবের হাতে তিন মাদক ব্যবসায়ী আটক হয়েছে। ইয়াবাসহ মাদকের আগ্রাসন বন্ধ করতে না পারলে জটিল রোগে আক্রান্ত মাদকসেবীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা ও অপারেশন্স শাখার পরিচালক পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মাসুম রাব্বানী জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে এই প্রথমবারের মতো শতাধিক চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীর আত্মসর্মপণ করার ঘটনা ঘটল। স্বাভাবিক কারণেই এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আশা করছি, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা আগের যে কোন সময়ের তুলনায় কমে আসবে। তবে দেশের ভেতরে মাদকটির চাহিদা তুলনামূলক বেশি। মাদক ব্যবসার সঙ্গে কাঁচা টাকার যোগসূত্র আছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই আত্মসর্মপণ ও কারাগারের বাইরে থাকা মাদক ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে। তারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনতে না পারলে, দেশের ভেতরে আগের মতো ইয়াবা তৈরির কারখানা স্থাপনের চেষ্টা করবে। ইয়াবার বিকল্প হিসেবে ফেনসিডিলের আগ্রাসন বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এজন্য স্থল সীমান্তে ফেনসিডিলের চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতরা আবারও সক্রিয় হতে পারে। সার্বিক বিষয়টি সম্পর্কে ইতোমধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা মোতাবেক দেশের ভেতরে যাতে ইয়াবা তৈরির কারখানা কেউ গড়ে তুলতে না পারে, এজন্য কড়া গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হচ্ছে। আর সীমান্তপথে যাতে ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদক আসতে না পারে, এজন্য সীমান্তে বিজিবি কড়া নজরদারি করছে। পাশাপাশি পুলিশ, র‌্যাব ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে মাদক আস্তানায় অভিযান, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের জেল জরিমানা করা হচ্ছে। দেশে যাতে আবার ফেনসিডিলের আগ্রাসন বাড়তে না পারে, এ জন্য বিজিবির সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো অব্যাহত আছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র মতে, ’১৪ সালের ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীর বাঁশপট্টির ১২০ নম্বর বাড়িতে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। কারখানায় উৎপাদিত প্রায় ১৩শ’ পিস ইয়াবা, ইয়াবা তৈরির কাঁচামালসহ গ্রেফতার হয় ইয়াবা প্রস্তুতকারীদের অন্যতম হোতা আলী আকবর (২৮) ও তার সহযোগী সোহেল (৩২), রুবেল (২৪) ও রাজ্জাক (৪৫)। সে বছরের ২৪ আগস্ট গুলশানের নিকেতন এলাকা থেকে ইয়াবা তৈরির অত্যাধুনিক কারখানা, ইয়াবা পরিবহনে ব্যবহৃত পাজেরো জীপসহ গ্রেফতার হয় আব্দুল্লাহ জুবায়ের ও তার তিন সহযোগী। কারখানা থেকে জব্দ হয় ইয়াবা তৈরির সব সরঞ্জাম ও কাঁচামাল। এদের তথ্য মোতাবেক অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মিরপুর-২ নম্বর থেকে গ্রেফতার করা হয় ভেজাল ইয়াবা তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত জসিম উদ্দিন ওরফে শিমুল, সৈয়দ তরিকুল ইসলাম ওরফে সুমন, আলী আকবর, জুবায়ের হোসেন জুয়েল ও আজাদ ওরফে টুটুল। আটকদের তথ্য মোতাবেক ’১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে টানা অভিযানে সাতটি ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পায় ডিবি পুলিশ। গ্রেফতার হয় ৩৭ জন। কারখানা থেকে জব্দ হয় ইয়াবা তৈরির কমপ্রেসার, মোটর, ইয়াবা তৈরির উপাদান মিশ্রণের যন্ত্র, স্প্রে মেশিন, ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল ও কেমিক্যালসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক) মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। সম্প্রতি ইয়াবা কারবারিদের একটি বড় অংশ আত্মসর্মপণ করায় জামিনপ্রাপ্তরা এমন সুযোগে আবার ইয়াবা তৈরির কারখানা স্থাপন করতে পারে। এমন আশঙ্কাকে মাথায় রেখে তারা যাতে নতুন করে আর ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে তুলতে না পারে, এজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জামিনপ্রাপ্তরা কে কোথায় আছে এবং তারা কি করছে তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে সারাদেশে ভেজাল ইয়াবা তৈরি ও বেচাকেনা সিন্ডিকেটের চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেফতারকৃত আলী আকবর নিজেই অন্তত ৫ লাখ ইয়াবা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেছে বলে স্বীকার করে। আলী আকবর বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস নামের একটি ওষুধ তৈরি কারখানার কেমিস্ট হিসেবে ছিল। ভেজাল ওষুধ তৈরির সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাকে জেলহাজতে যেতে হয়েছিল। ২০১২ সালে কারামুক্ত হয়ে ভেজাল ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরি শুরু করে। ভেজাল ইয়াবা তৈরির সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে কোন না কোন সময় কেমিস্ট হিসেবে চাকরি করত। গ্রেফতারকৃত জুবায়েরের ঢাকায় দুইটি ও চট্টগ্রামে দুইটি এবং কক্সবাজারেও কয়েকটি ইয়াবা তৈরির কারখানা ছিল। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও ডিবি পুলিশের দায়িত্বশীল উর্ধতন দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, ঢাকাসহ সারাদেশে বেচাকেনা হওয়া শতকরা আশি ভাগেরও বেশি ইয়াবা ট্যাবলেটই ভেজাল। ইয়াবা তৈরির প্রধান রাসায়নিক উপাদান হচ্ছে এমসিটামিন। এই রাসায়নিক পদার্থটি বাংলাদেশের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি সরকারী অনুমোদন নিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। তাদের হাত ঘুরেই রাসায়নিক পদার্থটি ভেজাল ইয়াবা প্রস্তুতকারীদের হাতে চলে যায়। আবার ওইসব ওষুধ কোম্পানিতে কেমিস্ট হিসেবে চাকরি করা অনেকেই পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে ইয়াবা তৈরি শুরু করে। বিদেশে কোন কোন চিকিৎসক প্রয়োজন অনুযায়ী কোন রোগীকে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবনের অনুমতি দিয়ে থাকেন। ইয়াবা ট্যাবলেট মূলত ক্ষুধামন্দা ও অধিক ওজনের ব্যক্তিদের হালকা পাতলা করতে চিকিৎসকরা রোগীদের প্রেসক্রাইভ করে থাকেন। ইয়াবা সাধারণত দশ থেকে পনের দিনের বেশি কোন রোগীকে সেবন করার অনুমতি দেন না চিকিৎসকরা। তবে দীর্ঘ বিরতির পর কোন কোন রোগীকে প্রয়োজন হলে ইয়াবা সেবনের অনুমতি দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। ইয়াবা প্রকৃতপক্ষে একটি ওষুধ। সত্যিকারের এমসিটামিন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি প্রতিটি ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম পড়বে কমপক্ষে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। দেশে উৎপাদিত ইয়াবা ট্যাবলেটে পরিমাণমতো এমসিটামিন নামক রাসায়নিক থাকে না। কারণ মিয়ানমার থেকে অনেক মাদক ব্যবসায়ী আসল ইয়াবা এনে দেশে এসে একশ পিস ইয়াবা দিয়ে একহাজার পিস ইয়াবা তৈরি করে বিক্রি করছে। আবার মিয়ানমার থেকেও নকল ইয়াবা আসছে। আসল ইয়াবা থেকে দামী বিস্কুটের মতো গন্ধ বের হয়। এজন্য নকল ইয়াবাকে আসল ইয়াবা হিসেবে চালিয়ে দিতে তৈরির সময় দামী বিস্কুটের সুগন্ধি ব্যবহার করছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক মাসুম রাব্বানী বলছেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো নিয়ম মেনে এমসিটামিন নামের রাসায়নিক পদার্থটির ব্যবহার করছে কিনা, তা মনিটরিং করার জন্য ওষুধ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। পাশাপাশি মনিটরিং অব্যাহত আছে। ভেজাল ইয়াবা তৈরির অন্যতম প্রধান উপকরণ সিওড্রএফিড্রিন আমদানি বন্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এমনকি কাশির ওষুধ তৈরিতে বিকল্প রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে। মাদক নিয়ন্ত্রণে এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে। ভেজাল হওয়ার কারণেই মাত্র দুই থেকে আড়াইশ’ টাকায় প্রতি পিস ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া যায়। অন্যথায় কোনক্রমেই এত সস্তায় পাওয়া যেত না। এদিকে মাদকবিরোধী চলমান অভিযানের ধারাবাহিকতায় শুক্রবার রাতে মোহাম্মদপুরের বসিলা মোড়ে পাথর বোঝাই ট্রাকে অভিযান চালিয়ে প্রায় নয়শ’ বোতল ফেনসিডিলসহ কামাল হোসেন (৪৫), খাইরুল ইসলাম (২৮) ও রাখেজ মোল্লা (২০) নামের তিন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-২। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের উপ-পরিচালক মেজর রইসুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, এসব ফেনসিডিল গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। আর আগে গ্রেফতারকৃতরা আরও তিনটি ফেনসিডিলের চালান সীমান্ত এলাকা থেকে ঢাকায় পৌঁছে দিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। ইয়াবা সেবনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, ইয়াবা সেবনে লিভার, কিডনি, হার্ট ও মস্তিষ্ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। দীর্ঘ সময় ইয়াবা সেবনের কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। কোন কোন ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে ইয়াবা সেবন করতে না পারলে উত্তেজিত হয়ে মানুষকে হত্যাও করতে পারে। নিজের শরীরে আঘাত করে। ইয়াবার টাকা জোগাড় করতে অনেক সময়ই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন ইয়াবাসেবীরা। দীর্ঘ সময় ইয়াবা সেবনে শরীর শুকিয়ে যায়। শরীরের ঘা হয়। যা আস্তে আস্তে শরীরে ক্যান্সারের সৃষ্টি করে। ইয়াবা সেবনে ঘুম না হওয়ায় উচ্চ রক্তচাপ হয়। কিডনি বিকল হয়ে পড়াসহ নানা জটিল রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের আগ্রাসন বন্ধ করা না গেলে জটিল রোগে আক্রান্ত মাদকসেবীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে।

আরো পড়ুন  

×