ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী চাকরি আইনের খসড়া চূড়ান্ত

জনস্বার্থে রাষ্ট্রপতির নিয়োগের আওতা বাড়ল

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২৭ মে ২০১৮

জনস্বার্থে রাষ্ট্রপতির নিয়োগের আওতা বাড়ল

তপন বিশ্বাস ॥ রাষ্ট্রপতির বিশেষ এখতিয়ারে জনস্বার্থে অনধিক ১০ শতাংশ পদে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে জনবল নিয়োগের বিধান রেখে সরকারী চাকরি আইন ২০১৮ এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতির কোটায় শুধু সচিব পদে ১০ শতাংশ পদে জনবল নিয়োগ দেয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়া কোন কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধের কারণে এক বছরের অধিক মেয়াদে কারাদ-, যাবজ্জীবন কারাদ- বা মৃত্যুদ-ে দ-িত হলে রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, আদালত কর্তৃক কারাদ-প্রাপ্ত ও চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারণকৃত ব্যক্তিকে অনুরূপ বরখাস্ত বা অপসারণ থেকে অব্যাহতি প্রদানের বিশেষ কারণ বা পরিস্থিতি রয়েছে তা হলে তিনি ওই ব্যক্তিকে ওই শাস্তি থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ওই কর্মচারী পুনরায় চাকরিতে বহাল হবেন। এক বছরের অধিক কতদিন তা আইনে বলা নেই। সরকারী চাকরিতে নিয়োগ লাভের একমাত্র মানদ- ও ভিত্তি হিসেবে মেধা এবং উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা স্থির করা হয়েছে। পদোন্নতির মানদ- ধরা হয়েছে কর্মচারীর মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ এবং সন্তোষজনক চাকরি। তবে সন্তোষজনক চাকরির কোন সংজ্ঞা নেই খসড়া এই আইনে। এখানেই কর্মকর্তারা পরস্পরকে ল্যাং মারার সুযোগ পাবেন। উল্লিখিত বিধিবিধান রেখে সরকারী কর্মচারী আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে; যা শীঘ্রই চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন কোন ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ করা যাবে না। সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তিতে আবশ্যিকভাবে পদের বেতন, কর্মপরিধি, নিয়োগ পরীক্ষার ধরন, পরীক্ষার বিষয়, নম্বর বিভাজন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ন্যূনতম নম্বর উল্লেখ থাকতে হবে। নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নয় এমন কোন ব্যক্তিকে নিয়োগের সুপারিশ করা যাবে না। যেসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্মকমিশনের কিংবা সরকারীভাবে গঠিত কমিটির সুপারিশ নেয়া বাধ্যতামূলক তা প্রতিপালন ব্যতিরেকে ওই সব পদে কাউকে নিয়োগ করা যাবে না। পদোন্নতির জন্য নির্ধারিত শর্ত পূরণ না করলে কিংবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে কাউকে পদোন্নতি দেয়া যাবে না। সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষানবিসকাল হবে ২ বছর এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগদানের তারিখ থেকে ১ বছর। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট না হলে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষানবিসকাল শেষে চাকরির অবসান করতে পারবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে পূর্বের পদে প্রত্যাবর্তন করানো যাবে। এই ক্ষেত্রে কোন ধরনের কারণ দর্শানোর প্রয়োজন হবে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে অন্য কোন ব্যক্তিকে, কর্মচারীকে, কিংবা কর্মচারিগণকে প্রজাতন্ত্রের কর্মের কোন পদে নিয়োগ, বদলি, প্রেষণে নিয়োগ কিংবা পদায়ন করা যাবে না। বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে কোন সরকারী কর্মচারীর চাকরির অবসান হবে। তাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেয়া হবে। তবে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা রুজুর প্রয়োজন হবে না। খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে কর্মচারীদের মধ্যে পারষ্পরিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হবে। কোন পদে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে সুস্পষ্ট বিধান না থাকলে, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ সম্ভব না হলে সরকার যে ধরনের উপযুক্ত মনে করবে সেভাবেই জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা জানান, এখানে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের সুস্পষ্ট বিধান থাকা জরুরী। অন্যথায় কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকে কর্মচারীকে তার প্রাপ্য অধিকার বঞ্চিত করার সুযোগ পাবে। উদ্বৃত্ত কর্মচারীদের আত্তীকরণ করা হবে। সমপদে না হলে একধাপ পরের পদে আত্তীকরণ করা হবে। তবে বেতন-ভাতা আগের পদের হিসেবে পাবেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কাউকে আত্তীকরণ করা যাবে না। আত্তীকরণকৃত কোন কর্মচারীকে কোন ধরনের পরীক্ষা, যোগ্যতা যাচাইয়ের কোন পরীক্ষা বা বয়সসীমা অর্জনের শর্তে আত্তীকরণ করা যাবে না। একজন কর্মচারী একবার আত্তীয়কৃত হবেন, একাধিকবার নয়। তবে সরকার চাইলে আত্তীকৃত কর্মচারীর চাকরির শর্ত সংক্রান্ত বিষয়ে এক বা একাধিক আদেশ জারি করতে পারবে। কোন সরকারী কর্মচারী আচরণ, শৃঙ্খলাজনিত কারণে দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে লঘু ও গুরুদ- আরোপের বিধান রয়েছে আইনটিতে। এতে বলা হয়েছে, লঘুদ- হিসেবে তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা, বেতন স্কেল নি¤œধাপে অবনমিতকরণ করা হবে। গুরুদ- হিসেবে নি¤œপদ বা নি¤œতর বেতন স্কেলে অবনতিমকরণ, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান, চাকরি থেকে অপসারণ এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। কোন সরকারী কর্মচারীর ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে সরকারী অর্থ বা সম্পত্তির ক্ষতিসাধিত হলে সরকার দায়ী কর্মচারীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করবে। প্রয়োজনে তার বেতন-ভাতা থেকে আদায় করা হবে। তাতেও সম্ভব না হলে কর্মচারীর বিরুদ্ধে পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি এ্যাক্ট ১৯১৩-এর অধীন আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে অভিযুক্ত কর্মচারী শাস্তির বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আপীল করতে পারবেন এবং কর্তৃপক্ষ যে রায় দেবে তা বহাল থাকবে। সেক্ষেত্রে শাস্তি বহাল থাকা বা বাতিল করার এখতিয়ার কর্তৃপক্ষের। রাষ্ট্রপতির রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপীল চলবে না। কোন সরকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির পর তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে। তার বিরুদ্ধে গৃহীত সকল দ- প্রত্যাহার করা হবে। তবে মামলা শেষ হতে তিনি অবসরে যাওয়ার বয়সে উপনীত হলে তাকে চাকরিতে আর বহাল করা যাবে না। তিনি শুধু আর্থিক সুবিধাদি পাওনা হবেন। কোন সরকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিযোগে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতারের দরকার হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করার বিধান রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইন ২০০৪ এর অধীনে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। এই ধারাটি ইতিপূর্বেও একাধিকবার সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছিল। কোন কর্মচারীর বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন থাকলেও তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা হবে না বলে বিধান রাখা হয়েছে। কোন কর্মচারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ছুটিতে গেলে বা অনুপস্থিত থাকলে প্রতিদিনের জন্য ১ দিনের মূল বেতন কাটা যাবে। অফিস চলাকালে বিনা অনুমতিতে অফিস ত্যাগ করলে প্রত্যেক বারের জন্য ১ দিনের মূল বেতনের সমান অর্থ কাটা যাবে। অফিসে উপস্থিতির ক্ষেত্রে ২ দিন বিলম্বে উপস্থিত হলে ১ দিনের মূল বেতন কাটা যাবে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা জানান,এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম করেন পদস্থ সরকারী কর্মচারীরা। তারা সব সময় দেরিতে অফিসে আসেন বলে একাধিক নি¤œ কর্মচারীর বক্তব্য। অফিস প্রধান তো মিটিংয়ের অজুহাতে বরাবরই দেরিতে অফিসে ঢোকেন। তাছাড়া অনেক কর্মকর্তা এমনকি সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার কেউ কেউ অভ্যাসগতভাবেই রাত ১০টা পর্যন্ত অফিস করেন। সেক্ষেত্রে সাধারণ কর্মচারীকেও গভীর রাত পর্যন্ত তাদের জন্য অফিসে অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া প্রি বছর রমজান মাসে গড়ে সব পর্যায়ের সরকারী কর্মচারীরা দেরিতে অফিসে ঢোকেন এবং সকাল সকাল বেরিয়ে যান। অথচ নিয়ম অনুসারে অফিস প্রধান সবার আগেই অফিসে আসার কথা। এসব সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বক্তব্য। কোন সরকারী কর্মচারী সরকারী স্বার্থ রক্ষার্থে শারীরিক বা অন্য কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ পাবেন। এছাড়া সরকারী কর্মচারীরা অনুদান, সহায়তা, সুধমুক্ত ঋণ এবং অগ্রিম প্রদান সুবিধা পাবেন। সরকারী কর্মচারীর পরিবার বলতে, কর্মচারী পুরুষ হলে স্ত্রী বা স্ত্রীগণ, মহিলা হলে তার স্বামী, কর্মচারীর সঙ্গে বসবাসরত এবং তার ওপর নির্ভরশীল সন্তানসন্ততিগণ, পিতা, মাতা, দত্তকপুত্র, নাবালেগ ভাই, অবিবাহিতা, তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা বোন পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। চাকরি ২৫ বছর পূর্তি হলে যে কোন কর্মচারী অবসরে যাওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করতে পারবেন। একবার লিখিত আবেদন করলেই তা চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে এবং কোনভাবে তা আর সংশোধন করা হবে না। ইতিপূর্বে তৈরি করা খসড়ায় অবসরের বয়স নির্ধারণ করা হয় ২০ বছর। চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত করার পর পর অবসরে গেলে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই কর্মচারী ভবিষ্যত তহবিলে জমা দেয়া চাঁদা, চাঁদার সুদ ছাড়া অন্য কোন সুবিধা পাওনা হবেন না। তবে সরকার বিশেষ বিবেচনায় অনুকম্পা হিসেবে অর্থ প্রদান করতে পারবে। অবসর সুবিধাভোগী কোন কর্মকর্তা গুরুতর অপরাধে দ-িত হলে বা গুরুতর কোন অসদাচরণের দোষে দোষী সাব্যস্ত হলে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে সরকার তার অবসর সুবিধা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে স্থগিত বা প্রত্যাহার করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মচারী জানান, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরও সরকারী কর্মচারী আইন ঘষামাজা করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত আইনটির খসড়া তৈরি করে তা আইন আকারে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৫৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আইন প্রণয়নের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন খোদ জনপ্রশাসনের কর্মচারীরাই। তারা বলছেন, একটি আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে এত টাকা খরচের কোন ঘটনা আইন প্রণয়নের ইতিহাসেই নেই। সূত্র জানায়, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত সব আইনের খসড়া তৈরি ও যাচাই-বাছাই হয় মন্ত্রণালয়টির বিধি উইং থেকে। এমনকি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা আইনের খসড়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলে তা বিধি উইং থেকেই দেয়া হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ রহস্যজনক কারণে সরকারী কর্মচারী আইন প্রণয়নের জন্য একটি প্রকল্প করা হয়েছিল। ওই প্রকল্পটি রাখা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এ্যান্ড ট্রেনিং (সিপিটি) উইংয়ের আওতায় এবং দীর্ঘদিন ধরে কাটাকাটির পর গত বছর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভের পরও আইনটি আলোর মুখ দেখেনি।
×