ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাগুরা ও শরীয়তপুরের তিন ভাষাসৈনিকের ভাগ্যে জোটেনি স্বীকৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 মাগুরা ও শরীয়তপুরের তিন ভাষাসৈনিকের ভাগ্যে জোটেনি স্বীকৃতি

সঞ্জয় রায় চৌধুরী, মাগুরা ও আবুল বাশার, শরীয়তপুর থেকে ॥ মার্তৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৫২ সালে যারা আন্দোলন করেছিলেন তাদের মধ্যে মাগুরা জেলায় এখনও দুইজন জীবিত রয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘদিন চলে গেলেও তাদের ভাগ্যে আজও রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি জোটেনি। এরা হলেন- এজি একাডেমির অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ভাষাসৈনিক খান জিয়াউল হক, মাগুরা পৌরসভার সাবেক কমিশনার ভাষাসৈনিক আমিনুল ইসলাম চাঁন্দু মিয়া। এদিকে, শরীয়তপুরের অন্যতম কৃতী সন্তান বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা আজও তাঁর যোগ্য মর্যদা পাননি। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলন চলার সময় তিনি সর্বদলীয় ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সংসদের (১৯৫১-৫২) সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েই শরীয়তপুরে শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। নির্মাণ করা হয়েছিল প্রথম শহীদ মিনার। অথচ এই বিখ্যাত ব্যক্তির নামে শরীয়তপুরে নেই তেমন কোন স্মৃতিস্তম্ভ! জানা যায়, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকার আন্দোলনের ধারা মাগুরাতে বয়ে গিয়েছিল। মাগুরায় মিছিল সমাবেশ হয়েছিল। যার পুরোভাগে ছিলেন এদের খান জিয়াউল হক, নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া, আব্দুল জলিল, আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া, আজিম দেওয়ান এবং শ্রীপুরের নাকোলে একে হামিদুজ্জামান এহিয়া প্রমুখ। মাগুরা নোমানী ময়দান থেকে মিছিল বের হয়ে চৌরঙ্গী মোড়ে সমাবেশ হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেলেও মাগুরার ভাষা সৈনিকদের কপালে জোটেনি কোন স্বীকৃতি। ইতোমধ্যে ভাষা সৈনিকদের আনেকেই মারা গেছেন। বেঁচে আছেন হাতে গোনা কয়েকজন। এর মধ্যে দুইজন হলেনÑ এজি একাডেমির অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খান জিয়াউল হক ও মাগুরা পৌরসভার সাবেক কমিশনার আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া। এদের দুই জনের বাড়ি মাগুরা শহরের জামে মসজিদ সড়ক ও ইসলামপুর পাড়ায়। খান জিয়াউল হক মাগুরা এজি একাডেমি হাইস্কুলে দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বর্তমান অবসর জীবন যাপন করছেন। পাশাপাশি বহু সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত। তিনি মাগুরা পৌরসভার সাবেক কমিশনার ছিলেন। দুইজনের বর্তমান বয়স আশিউর্ধ। বয়সের কারণে হাঁটাচলা সীমিত হয়ে গেছে। কয়েকবছর পূর্বে ভাষাসৈনিক খান জিয়াউল হক, আমিনুল ইসলাম মিয়াকে সম্মাননা প্রদান করেছিল জেলা কবি-সাহিত্যিক ঐক্যজোট পরিষদ। এ বছর একটি সংগঠন খান জিয়াউল হককে সম্মাননা প্রদান করবে তবে ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘদিন চলে গেলেও তাদের কপালে কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জোটেনি । ডাঃ গোলাম মাওলা : বাংলাদেশে যারা ভাষাসৈনিক রূপে খ্যাত শরীয়তপুরের কৃতী সন্তান ডাঃ গোলাম মাওলা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বেই মেডিক্যালের ছাত্ররা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সংসদের (১৯৫১-৫২) সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁর ডাকেই সারা দিয়ে শরীয়তপুরে শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। নির্মাণ করা হয়েছিল প্রথম শহীদ মিনার। অথচ এই বিখ্যাত ব্যক্তির নামে নেই তেমন কোন স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে তারা। ভাষাসৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা ১৯১৭ সালে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার পোড়াগাছা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শরীয়তপুরবাসী ভাষাসৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলার জন্য গর্বিত। বিখ্যাত এই ভাষাসৈনিকের নামে শরীয়তপুরে দু/একটি স্থাপনা ছাড়া আর কোন স্মৃতি চোখে পড়ে না। শরীয়তপুর সদরে রয়েছে ভাষাসৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা গণগ্রান্থাগার। তার বাড়ির কাছে ডাঃ গোলাম মাওলা নামে একটি সড়ক ও একটি ব্রিজের নামকরণ করা হলেও সেগুলোর এখন বেহাল দশা। ডাঃ গোলাম মাওলা ছিলেন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সিনিয়র সহ-সভাপতি। নিজ গ্রামের বাড়ি ডাঃ গোলাম মাওলার বসতঘর যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও রাত্রিযাপন করেছিলেন সেটিও এখন জরাজীর্ণ। বাড়িতে নেই বিদ্যুত সংযোগ। নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য একটি ভাস্কর্যসহ তার নামে স্থাপনা নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তার সন্তান ডাঃ গোলাম ফারুখসহ ও এলাকাবাসী। শরীয়তপুরের ভাষাসৈনিক জালাল উদ্দীন আহমেদ জানান, ডাঃ গোলাম মাওলার নেতৃত্বে যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, তখন তার আহ্বানে উজ্জীবিত হয়ে শরীয়তপুরের ছাত্ররাও ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তান সরকার যখন ভাষার উপর অত্যাচার শুরু করেন তখন ডাঃ গোলাম মাওলা সংগঠন করে আন্দোলন শুরু করেন। এর প্রভাব পড়ে শরীয়তপুরেও। শরীয়তপুরের পালং তুলাসার গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র জালাল উদ্দীন আহমেদ এবং আলী আহাম্মদ মিয়াসহ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন মিছিল মিটিং করে বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন চালায়। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলাগাছের শহীদ মিনার বানিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তারা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৮ সালে উক্ত বিদ্যালয় মাঠে ইট বালু দিয়ে নির্মাণ করা হয় জেলার প্রথম শহীদ মিনার। এখন জেলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার রয়েছে। শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল হোসাইন খান ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ছাবেদুর রহমান খোকা সিকদার উভয়ই এই বিশিষ্ট ভাষাবিদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার আশ্বাস দিয়েছেন। দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ভাষাসৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা ১৯৬৭ সালের ২৯ মে অল্প বয়সে চর্মরোগের কারণে ইন্তেকাল করেন।
×