ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সব পক্ষের যথাযথ সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ

এক লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বদলে যাবে চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১৪ আগস্ট ২০১৭

এক লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বদলে যাবে চট্টগ্রাম

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামের উন্নয়নে তথা দেশের স্বার্থে বর্তমান সরকার প্রায় এক লাখ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার পর ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটির কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। এসব প্রকল্প চট্টগ্রাম মহানগরী, মীরসরাই, আনোয়ারা, মহেশখালী হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। এত বিপুল অর্থের বিপরীতে প্রকল্পসমূহের সঠিক বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামের চেহারা যেমন পাল্টে যাবে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। এ আশাবাদ বিশেষজ্ঞ মহলসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রের। চট্টগ্রাম মহানগরীর জন্য সর্বশেষ পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার যে তিনটি মেগা প্রকল্প অতিসম্প্রতি একনেকে অনুমোদিত হয়েছে, তা মূলত ইতোমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া খালসমূহের পুনঃখনন, সংস্কার ও উন্নয়নকাজে ব্যয় হবে নগরীতে ভয়াবহ জলজট পরিস্থিতি দূরীকরণে। কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (চউক)। সংস্থার চেয়ারম্যান গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে জানান দিয়েছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের ভয়াবহ জলজট পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নগরীর তিনটি প্রধান সেবামূলক সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), চউক ও চট্টগ্রাম ওয়াসার আঞ্চলিক সমন্বয় সাধনের বিষয়টি রয়েছে সর্বাগ্রে। তিন সংস্থার কর্ণধারের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন যে রয়েছে তা প্রকাশ্য। চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন নির্বাচিত। চউক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সরকার মনোনীত। তিন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও টানাপোড়েনের কারণেই সরকারপক্ষে এবার সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এমপি গৃহায়ন ও পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে। প্রতি বছর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারী বরাদ্দ আসছে। কিন্তু এর বাস্তবিক সুফল জনগণ পাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সর্বশেষ পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার তিনটি মেগা প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হওয়ার পর চসিকের কাজের বড় একটি অংশ হাতছাড়া হয়ে চলে গেছে চউকের কাছে। বিষয়টি একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনেই হয়েছে। ফলে চউক চেয়ারম্যান ইতোমধ্যেই সমন্বয় কাজে চসিক মেয়রের সহযোগিতা কামনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। আবার চসিক মেয়রও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সেবাসমূহের কাজে সহযোগিতা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিন মেগা প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ফজলুল্লাহর আহ্বানে তিন সংস্থার পক্ষে প্রথম পর্যায়ের একটি সমন্বয় বৈঠক হয়েছে গত শনিবার। এতে চসিক ও ওয়াসার প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে মূল সমস্যা নিরসনে প্রাথমিক আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের পথে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে সরকারী উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য ইতিবাচক আর দেশ ও চট্টগ্রামের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু আবার এ কথা সত্য যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন সংস্থা নির্ধারিত করে দেয়ার পর নেপথ্যে যে নানা দোলাচল সৃষ্টি হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। তিন সংস্থার কর্ণধাররা মুখে যত কথাই বলুন না কেন, এতে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিয়ে এক পক্ষের আনন্দ-উল্লাস যেমন রয়েছে, তেমনি অন্য পক্ষের জন্য নতুন করে হতাশার জন্মও নিয়েছে। সরকারপ্রধান ও নীতিনির্ধারক মহল যাতে অসন্তুষ্ট না হন এমন কোন প্রকাশ্য তৎপরতা হয়ত তাদের পক্ষে দৃশ্যমানভাবে চালানো সম্ভব হবে না। কিন্তু নেপথ্যে আন্তরিক পরিবেশ সৃষ্টিতে তৎপর হওয়া নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্নটি রয়ে গেছে। চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর অতীতের দীর্ঘ সময়ের জঞ্জাল সাফ করতে সফল হননি গেল দু’বছরে। এ কথা তিনি নিজ মুখে স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি নগরবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর অন্য দুই সংস্থা চউক ও ওয়াসার কাঁধে জনসেবামূলক কাজের সফলতা বা ব্যর্থতা তত দৃশ্যমান না হওয়ায় তাদের নিয়ে সমালোচনা বহুলাংশে কম। কিন্তু ব্যর্থতা যে নেই তা নয়। নেতাদের রাজনীতি, দলীয় গ্রুপিং, বিভেদ, একক আধিপত্য বিস্তারের অপতৎপরতার গ্যাঁড়াকলে ফেলে কে কাকে ল্যাং মেরে কুপোকাত করবেন এমন অপপ্রয়াসের কমতি যে নেই তা পরিষ্কার। ফলে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়নে বছর বছর সরকারী বরাদ্দের বিপুল অর্থ একদিকে যেমন জলে গেছে, তেমনি গেছে লোপাটকারীদের পকেটেও। বর্তমান বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামে যে মহাদুর্যোগ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং এতে জনমত যে বেঁকে গেছে তারই প্রেক্ষিতে বিশেষ করে জলজট পরিস্থিতি উত্তরণে চসিক ও চউক পৃথকভাবে প্রকল্প পেশ করে সরকারের কাছে। কিন্তু অনুমোদন পেয়েছে চউকের প্রকল্পসমূহ। এতে চসিক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের গাত্রদাহ হওয়ারই কথা। যদিও এখনও তা ভেতরে ভেতরে। চসিক মেয়র স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে চট্টগ্রামের জন্য মেগা প্রকল্প গ্রহণ করায় সরকারপ্রধানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অনুরূপভাবে চউক চেয়ারম্যানও একই পন্থা অনুসরণ করেছেন। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে চট্টগ্রামের উন্নয়নের অভিভাবক আখ্যা দিয়ে আহূত সংবাদ সম্মেলনে চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে চসিকের সহযোগিতা চেয়েছেন। এক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়টি চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের ওপরই বর্তায়। এসব আহ্বানের নেপথ্যে যে তাদের ভেতরে অসহযোগিতার পরিবেশ রয়েছে তা-ই প্রমাণ করে। তবে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে চট্টগ্রামবাসীর জন্য সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট অনেকাংশে কাটাতে সক্ষম হওয়ায় অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থান গড়তে সক্ষম হয়েছে। রাঙ্গুনিয়ায় ‘শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার’ প্রকল্প সম্পন্ন করে চালু হওয়ার পর মহানগরীতে পানির চাহিদার তীব্র সঙ্কট হ্রাস পেয়েছে। জাপানী সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ওয়াসার আরও প্রকল্প বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তিন সংস্থার সমন্বয়হীনতা চট্টগ্রামের জন্য দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছু বয়ে আনেনি। অপরদিকে, চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের আরেক মেগা প্রকল্পের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে এলএনজি ও তাপবিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প, মীরসরাই ও আনোয়ারায় বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ এ সরকারের উন্নয়নকাজের একেকটি বড় মাইলফলক। টানেল নির্মাণ, বিশেষায়িত জোন প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক বা দলীয় গ্রুপিং এবং প্রতিবন্ধকতা নেই। কিন্তু চট্টগ্রামে জলজটে সৃষ্ট ভয়ানক পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারদলীয় নেতাদের আধিপত্য বিস্তারের অপতৎপরতা রয়েছে। পাশাপাশি যথাযথ স্থানে যথাযথ প্রকল্প গ্রহণ না করে অন্যত্র তা বাস্তবায়নের ঘটনাও রয়েছে। ফলে সরকারী বিপুল অর্থ ব্যয়ে বাস্তবায়িত বেশকিছু প্রকল্প সফলতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে। মহানগরীর ৪২টি খালের মধ্যে ৩৬টি খাল বহু আগে থেকেই ভরাট এবং এগুলোর দু’পাড় অবৈধ দখলধারদের দখলদারিত্বে চলে গেছে। চসিক ইতোমধ্যে অবৈধ দখল উচ্ছেদ শুরু করেছে। চউক বলেছে, যারা নির্মাণকাজের অনুমোদন নিয়ে অবৈধভাবে দালানকোঠা গড়ে তুলেছে তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে উচ্ছেদ করা হবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরায় খনন করে এবং ভরাট হয়ে যাওয়া খালগুলো সংস্কার করা হবে এসব মেগা প্রকল্পের আওতায়। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানানো হয়েছে, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বরাবরই চট্টগ্রামে পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহী। আর এ কারণেই সরকার চট্টগ্রামকেন্দ্রিক বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে। আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে টেকনাফের ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন প্রতিষ্ঠায় ভূমি অধিগ্রহণের কাজও এগিয়ে চলেছে। এ রেললাইন মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্তি ঘটাবে। মিয়ানমার হয়ে এ যোগাযোগ ব্যবস্থা যাবে সুদূর চীন পর্যন্ত, যা আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল উন্নয়ন সাধন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারের এসব উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে মোদ্দা কথা বিশেষজ্ঞ মহল থেকে একটিই বলা হচ্ছে, সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের একে অপরের প্রতি ল্যাং মারামারির তৎপরতা থেকে সরে গিয়ে আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সমন্বয় সাধনে তৎপর হলেই বাস্তবিক অর্থে এত বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রকল্পসমূহ সুফল বয়ে আনবে। হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হওয়ার পর সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে উল্লসিত। আবার কারও কারও মাঝে হতাশারও জন্ম নিয়েছে। মূলত এ হতাশা ব্যক্তিস্বার্থ ও আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক। কিন্তু সরকারপক্ষে এসব নিয়ে হিসাব-নিকাশ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা বাস্তবায়নে সেবা সংস্থাসমূহের আন্তরিকতা ও সহযোগিতার বিষয়টি। এক্ষেত্রে ব্যত্যয় হলে সরকারী বিপুল অর্থের বিনিময়ে যেমন সফলতার হার শতভাগ হবে না, তেমনি নগরবাসীর দুর্ভোগেরও অবসান ঘটবে না। আর দুর্ভোগ যদি রয়েই যায় দেশী-বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগে যেমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে, তেমনি উন্নয়ন কর্মকা-ের যে ছক সরকার গ্রহণ করেছে তাতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার বিষয়টি রয়ে যাবে।
×