ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পরামর্শ আইনজ্ঞদের

মামলার ভারে ন্যুব্জ উচ্চ ও নিম্ন আদালত

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২১ জুন ২০১৬

মামলার ভারে ন্যুব্জ উচ্চ ও নিম্ন আদালত

বিকাশ দত্ত ॥ আদালতের বাইরে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতি ব্যবহার করে আদালতে বিচারাধীন মামলার জট কমিয়ে আনা সম্ভব। মামলা বা বিরোধ নিষ্পত্তির এ অনানুষ্ঠানিক বা উপানুষ্ঠানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেক দেশই সুফল পেয়েছে। কোন কোন দেশ মামলার সংখ্যা ৩/৪ মাসে আশানুরূপভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির উপর জোর দেয়া হলে মামলার সংখ্যা বাড়ত না। পাশাপাশি এক জনের সাথে আরেক জনের শত্রুতা, অর্থ ও সময়ের অপচয় হতে রেহাই পাওয়া যেত। এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, আইন করা হয়েছে, এখন গেজেট নোটিফিকেশন করে বিভিন্ন জেলায় প্রয়োগ করা। এর আগে এ বিষয়ে অবসর প্রাপ্ত জেলা জজদের ট্রেনিং ও দেয়া হয়েছিল। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা গেলে যেমন শত্রুতা কমবে অন্যদিকে সময় ও অর্থও বাঁচবে। মামলার ভারে ন্যুব্জ উচ্চ ও নিম্ন আদালত। এসব আদালতে ক্রমাগত মামলা জট বাড়ছেই। বর্তমানে উচ্চ আদালতসহ সারা দেশে ৩১ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির উপর গুরুত্বারোপ করলে মামলার জট অনেকাংশেই কমে যাবে। আদালতের পাশাপাশি জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (লিগ্যাল এইড) ও এডিআর এর উপর গুরুত্ব দিয়েছে। লিগ্যাল এইড সরকারী আইন সহায়তা কার্যক্রমের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জেলা লিগ্যাল এইউ অফিসকে ‘এডিআর কর্ণার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্র স্থল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। সূত্র মতে, পদ্ধতিগত কারণে মামলা দীর্ঘ জটযুক্ত হচ্ছে। সনাতনী পদ্ধতি গত কারণে মামলা জট বেড়ে যাচ্ছে। কারণ অনেক মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষের মতে, নোটিস জারি হয় বছরের পর বছর বিলম্বে। অপরদিকে নোটিস জারি যথাযথ না হবার কারণে পুনরায় নোটিস জারি করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সেকশনে নোটিন জারি হয়ে ফেরৎ আসায় পরে ভুল নথিতে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে নোট প্রদান করা হয় না। জারির তথ্য সেকশনেই পড়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে হারিয়েও যায়। এ কারণে মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত হতেই দীর্ঘবিলম্ব হয়। পুনরায মামলাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদালতের শুনানির তালিকায় অন্তভুক্ত অনিবার্য হলেও তা করা হয় না। আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায সেকশনে চলে যায়। নতুন করে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে শুনানি অন্তে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এ সমস্ত দূর করতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। সম্প্রতি আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক সংসদে বলেছেন, উচ্চ আদালতে প্রায় ৪ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানী ৮৭হাজার ৯৬৪, ফৌজদারি ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৫, রিট ৬৩ হাজার ২৫০ এবং আদিম ৭হাজার ৭৪। এ ছাড়া সুপ্রীমকোর্ট রেজিস্ট্রার কার্যালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও আইনকমিশন সূত্রে জানা গেছে সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগসহ সকল জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ম্যাজিস্ট্র্রেট আদালতে ৩০ লাখ ৯৪ হাজার ৪৭৪ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে আপীল বিভাগে ১২ হাজার ৪৬২, হাইকোর্ট বিভাগে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩১০, দেশের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৪ এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ( সিএম এম /সিজেএম) ৯লাখ ৩৯ হাজার ২৮। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট আইনও সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সে সুফল আমরা এখনও ভোগ করতে পারিনি। আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লেগে যায়। অনেক মামলাতেই বিচার যখন পাওয়া যায়, ন্যায়বিচারের তখন আর কোন প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। তাই, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির দিকে আমাদের বেশি নজর দিতে হবে। তবে, এক্ষেত্রে আইনজীবী ও বিচারের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত বিচারককে এসব মামলায় সমঝোতাকারীর ভূমিকা পালন করতে হয়। বিচারকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আইনজীবীদের সহযোগিতা ছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব না। মামলার ভারে জর্জরিত আদালতের কার্যতালিকায় প্রতিদিনই জমা হচ্ছে আরও নতুন নতুন মামলা। প্রতিদিনই বেড়ে চলছে মামলার সংখ্যা। আমাদের আনুষ্ঠানিক আদালত বা বিচার ব্যবস্থার পক্ষে সময়মতো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে বিচার সম্পন্ন করা দুরূহ। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আগের তুলনায় মামলা জট কমতে শুরু করেছে। আমাদেরকে নজর দিতে হবে নতুন যে মামলা হচ্ছে তার চেয়ে যাতে বেশি করে নিষ্পত্তি হয় । সে দিকেই বেশি নজর দিতে হবে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা গেলে মামলার জট অনেকাংশে কমে যাবে। সূত্র মতে কোন কোন দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে ১৫-২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগে। এসব মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু কিছু আইনজীবী ও বিদ্যমান ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্টরা এসব মামলা জিয়িয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করেন। মানুষ মরে যায়, অথব দেওয়ানি মামলা চলে কয়েক পুরুষ ধরে। এ ব্যবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন। বিচার প্রার্থীরা বিচারের আশায় লাখ লাখ খরচ করে, কিন্তু তারপরও কাক্সিক্ষত বিচার তারা পায় না। দিনের পর দিন সময় প্রার্থনা নামে সুপরিকল্পিতভাব ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। আইনকমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে আইন মন্ত্রণালয়ের এক পত্রে দেওয়ানী মামলার বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির এ ডি আর কিভাবে অধিকতর কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা যায় সে মর্মে আইন কমিশনের সুপারিশ চাওয়া হয়। ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ও অনুরূপ কোন চিন্তাভাবনা করা যায় কিনা তাও পত্রে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে দেওয়ানী কার্যবিধিতে ৮৯ এ ৮৯বি তে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধানাবলী যুক্তি করা হয়েছিল। যা সফল হয় নি। আইন কমিশনের ইতিহাসে কোন একক প্রকল্প হিসেবে এডিআর এর উপরই সবচেয়ে বেশি সময় ব্যায় করা হয়। কমিশন সব কিছু বিবেচনা নিয়ে সরকারের নিকট এডিআর বিষয়ে একটি দীর্ঘ ও পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ প্রতিবেদন প্রেরণ করে। যা দেওয়ানী বিধির ২০১২ সালের সংশোধনীতে গ্রহণ করা হয়েছে। এই সংশোধনীও কাঙ্কিত ফল অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (লিগ্যাল এইড) ও এডিআর’র ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। লিগ্যাল এইড সরকারী আইন সহায়তা কার্যক্রমের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জেলা লিগ্যাল এইউ অফিসকে ‘এডিআর কর্নার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্র স্থল” হিসেবে প্রতিষ্টা করা। আপোসযোগ্য মামলাসমূহ জেলা লিগ্যাল অফিসারের মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে আদালত বা ট্রাইব্যুনাল হতে মামলা প্রেরণের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে প্রয়োজনীয় সংশোধন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিচারপ্রার্থী মানুষকে আইনী পরামর্শ প্রদান ও আপোসযোগ্য বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিকল্প বিরোধ পদ্ধতি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত দরিদ্র্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করা।
×