ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রবাসে ঈদের উৎসব, বিষাদের প্রতিচ্ছবি

মোহাম্মদ সানাউল হক, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রিয়াদ

প্রকাশিত: ১৭:৫৯, ৫ জুন ২০২৫

প্রবাসে ঈদের উৎসব, বিষাদের প্রতিচ্ছবি

ছবি: সংগৃহীত

ভালো পরিবেশে বসবাস, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার আশায় প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি প্রবাসে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জনশুমারি অনুযায়ী, বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখের অধিক। এর মধ্যে সৌদি আরবেই রয়েছে প্রায় ২.১২ মিলিয়ন প্রবাসী, যা প্রবাসীদের মধ্যে সর্বোচ্চ।

‘ঈদ’ শব্দের অর্থই হলো আনন্দ। এই দিনটি বারবার ফিরে আসে বলেই এর এমন নামকরণ। ঈদের দিন নামাজ শেষে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কোলাকুলি, সালামি বিতরণ, সেমাই-পায়েস রান্না আর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে হাসি-আড্ডায় মেতে ওঠাই ঈদের মূল সৌন্দর্য। কিন্তু, বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকা অধিকাংশ প্রবাসীর জন্য এই সব আয়োজন শুধুই এক অপূর্ণ স্বপ্ন।

আমি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের কথা বলছিলাম, কেননা প্রবাসে ঈদের দিনেও বেশিরভাগ প্রবাসীর ভাগ্যে ছুটি থাকেনা! এমন ও হয় যে, অনেক প্রবাসী ঈদের নামাজটুকুও আদায় করার সুযোগ পায়না! সেক্ষেত্রে এমন প্রবাসীদের যদি প্রশ্ন করা হয় ঈদ কেমন কাটলো? এমতাবস্থায় ঐ প্রবাসীর উত্তরটা কেমন হৃদয়বিদারক হবে, তা আর বলার বাকি রইলো না!

সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ মহসিন মাল জানান, “রাজধানী রিয়াদের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে গত রমজানে ঈদের আগের দিন—অর্থাৎ চাঁদরাতে—আমার নাইট ডিউটি ছিল। যেহেতু ঈদের কয়েক দিন আগেই স্থানীয় নাগরিকদের দীর্ঘ ছুটি শুরু হয়ে যায়, তাই আমাদের মতো প্রবাসীদের ওপর অতিরিক্ত ডিউটির চাপ পড়ে। সারারাত কাজ শেষে ভোরে বাসায় ফিরতেই সুপারভাইজার ম্যাসেজ করে জানালেন—ঈদের দিন সকাল ৭টায় আবারও ডিউটিতে যোগ দিতে হবে। মালিকপক্ষের নির্দেশ, কোনোরকম অজুহাত দেওয়ার সুযোগ নেই। বাধ্য হয়েই আবার প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে ক্লিনিকে ফিরতে হলো।”

তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের আগের রাতে প্রিয়জনের দেওয়া ভালোবাসামাখা পাঞ্জাবি পড়ে ঈদের নামাজে যাব, তারপর সেমাই রান্না করে রুমমেটদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করব।এটাই ছিল মন ভরা ছোট্ট একটা পরিকল্পনা। কিন্তু বাস্তবতা ছিল নির্মমভাবে ভিন্ন। ঈদের আগের রাত এবং ঈদের দিনের ক্লান্তিকর ডিউটির পর নিস্তেজ শরীরে বাসায় ফিরে সেই প্রতীক্ষিত ঈদের আনন্দের সামান্য ছোঁয়াটুকু অনুভব করতে পারিনি।’"

প্রবাসী শাহ-জালাল বলেন, ‘অনেক প্রবাসী রয়েছেন, যারা ঈদের দিনেও জীবিকার তাগিদে ছুটে বেড়ান। তাদের কাছে ঈদের আনন্দের চেয়ে একটি চাকরির সুযোগই যেন বড় সুখের বিষয়। যেমন আমার রুমমেট হাসিব ভাই—গত সাত বছর ধরে সৌদি আরবে কর্মরত। আজও দেশে ফিরতে পারেননি। পারিবারিক দায়-দেনা, অভাব-অনটন তাকে আটকে রেখেছে প্রবাসের মাটিতে। অথচ প্রতি ঈদেই তিনি পরিবারকে লাখ টাকা পাঠান, নিজে পরেন পুরোনো জামা, ঈদের আনন্দ বিলিয়ে দেন আপনজনদের মাঝে নিজে না থেকেও।’"

তিনি আরোও জানান, প্রবাসে আমার দেখা অনেক ভাই-বন্ধু আছেন, যারা ঈদের দিন ছুটি পান—শুধু ঈদের দিনই নয়, বরং ঈদের পরবর্তী ৪-৫ দিন পর্যন্ত ছুটি কাটান। ঈদের নামাজ আদায় শেষে তাঁরা দলবদ্ধভাবে ঘুরতে বের হন, খানাপিনা করেন, আড্ডা, আনন্দ আর মোজ-মাস্তিতে মেতে ওঠেন। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, যেন ঈদের সব রঙ, সব আনন্দ তাঁরা হৃদয়ভরে উপভোগ করছেন। কিন্তু একান্ত নির্জনে যদি তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয়, "ভাই, ঈদ কেমন কাটলো?"—তাঁদের চোখে তখন এক অজানা বিষাদের ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এত আয়োজন, এত আনন্দের মাঝেও যেন পরিবার-পরিজনের অপূর্ণতা থেকে যায়। ঈদের পরিপূর্ণতা তখন আর হৃদয় ছুঁয়ে যায় না।

প্রবাসীদের ঈদ মানে উট কুরবানি নয়, দামী খাবার নয়—বরং একটি ভালো চাকরির নিশ্চয়তা, মাস শেষে পরিবারের জন্য টাকা পাঠানোর সক্ষমতা, এবং পরিবার সুস্থ আছে, এসব খবর নিশ্চিত হহলেই তাদের কাছে ঈদের আনন্দ লাগে।

অনেক প্রবাসী আছেন যারা রমজান মাসে মসজিদের ইফতার নেওয়ার জন্য লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন, শুধু কিছু রিয়াল বাঁচানোর আশায়। সেই সঞ্চয় যদি দেশে পরিবারের কাজে লাগে, তাতেই তারা তৃপ্ত। প্রবাসীদের ঈদ মানে বিলাসিতা নয়, বরং দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগ। তাদের কাছে ঈদের আনন্দ মানে পরিবারকে সবসময় হাসিমুখে দেখা, সন্তানদের স্কুলে যাওয়ায়, মা-বাবার সাথে ফোনকলে কথা বলা , স্ত্রীর মুখটা সবসময় হাসিখুশিতে থাকা।
 

সাব্বির

×