ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ জুন ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হাজার বছর ধরে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে  সাপ্তাহিক হাট

সোহাইব মাকসুদ নুরনবী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ৬ জুন ২০২৫

হাজার বছর ধরে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে  সাপ্তাহিক হাট

 

হাজার বছর ধরে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে সাপ্তাহিক হাট। গ্রামীণ মানুষদের বিভিন্ন পণ্য বিকিকিনি, সামাজিক সু-সম্পর্ক, দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ,  লালন ও চর্চা করে আসছে এসকল হাট।

সাধারণত সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটি দিনে নির্দিষ্ট স্থানে হাটগুলো বসায়,  এর নামকরণ করা হয় সাপ্তাহিক হাট। 

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল, শাকসবজি, দুধ, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু  ইত্যাদি সরাসরি বিক্রি করেন সাপ্তাহিক হাটে। ছোট দোকানি, হস্তশিল্পী, দর্জি বা খাদ্য প্রস্তুতকারীরা বসেন পণ্যের পসরা সাজিয়ে। এখানে দেখা মেলে পুকুর,নদী ও সাগর থেকে ধরা নানা দেশীয় মাছের। যা কিনতে শোরগোল পরে মাছপট্টিতে। এছাড়া মৌসুমী টাটকা ফল, মুখরোচক খাবার, পোশাক,প্রসাধণীসহ গৃহস্থলী পণ্যের সবকিছুই পাওয়া যায় এখানে।  তবে এমন অনেক হাট ই  এখন বিলুপ্তির পথে।

বিলুপ্তির যুগেও পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনও জমজমাটভাবে বসে সাপ্তাহিক হাট। এদের মধ্যে সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানেই সপ্তাহের বিভিন্ন সময়ে বসে প্রায় ৩১ টি হাট। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: খাটাশিয়া হাট, বোতলবুনিয়া হাট, বাঁধঘাট হাট, খাঁসের হাট, কাজীর হাট, পুকুরজনা হাট, ছোটবিঘাই হাট, হাজিখালী হাট,ইটবাড়িয়া হাট,  সোমারের হাট, মৌকরণ হাট, শ্রীরামপুর হাট, শ্রীরামপুর কলের হাট,পালের হাট,  ধরান্দি হাট, সেহকাঠী হাট ইত্যাদি। হাটগুলোর রয়েছে নিজ নিজ ঐতিহ্য। এসকল হাট থেকে পুরো এক সপ্তাহের বাজার করেন স্থানীয়রা।

প্রতি বৃহস্পতিবারে অনুষ্ঠিত হওয়া বোতলবুনিয়া হাটে পণ্য কিনতে আসা কৃষক আবু মল্লিক বলেন, "মোরা প্রত্যেক সপ্তায় এহান দিয়া বাজার হরি, পুরা এক সপ্তাহ খাই। তাজা কিনি তাজা ই খাই, এই লইজ্ঞা মোগো কোনো রোগ-শোক নাই!"

দুটো দেশীয় মুরগী হাতে হাটে এসেছেন আরেক কৃষক করিম মিয়া,  কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, "নিজের পালা মুরহা, এ দুইডা বেচমু। হেই টাহা দিয়া পেয়াজ-রোশন মাছসহ শাকসবজি কিনমু।"

সোমবারে অনুষ্ঠিত সাপ্তাহিক হাট কাজীর হাটে আসা তরুণ আবদুল কাইউম বলেন,  "বাড়িতে মেহমান এসেছেন, তাই হাটে আসলাম। এখান থেকে মাছ,মুরগী ও আম-কাঠাল কিনব। হাতের নাগালেই সবকিছু পাওয়া যায়, কষ্ট করে শহরে যেতে হয়না। বিষয়টি খুব ই ভালো লাগে।"


জানা যায়, গ্রামীণ হাটের ইতিহাস সেই  প্রাচীন আমলের (খ্রিস্টপূর্ব সময়কালের)। কৃষিনির্ভর সমাজ গঠনের পর থেকেই মানুষ পণ্য বিনিময়ের জন্য একত্রিত হতে শুরু করে।
তখন মুদ্রার প্রচলন না থাকায় বার্টার সিস্টেম (বিনিময় প্রথা) ছিল চালু।এই সময়ই হাট বা বাজারের প্রাথমিক ধারণা জন্ম নেয়। মধ্যযুগে (১০০০ খ্রিস্টাব্দ–১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) যা আরও প্রসার লাভ করে।তখন বাংলার গ্রামে গ্রামে হাট বসার রেওয়াজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপরে মুসলিম শাসনামলে (বিশেষ করে সুলতানি ও মুঘল আমলে) হাটের সংখ্যা বাড়তে থাকে, এবং প্রশাসন থেকেও নিয়ন্ত্রণ ও কর আদায় হতো।
হাট সংলগ্ন এলাকাগুলোতে জনবসতি গড়ে ওঠে এবং অনেক স্থানের নাম হয় হাট-ভিত্তিক (যেমন: কাজীর হাট, খাসের হাট ইত্যাদি)।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে (১৭৫৭–১৯৪৭) প্রশাসনিকভাবে হাটগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও কর সংগ্রহের পদ্ধতি আরও সুসংগঠিত হয়। কিছু হাট পাকা রাস্তা ও স্থায়ী দোকানপাটেও উন্নীত হয়।

জমিদার ও স্থানীয় রাজা ও জমিদাররা অনেক হাট প্রতিষ্ঠা করেন।
সর্বশেষ আধুনিক বাংলাদেশে (১৯৭১-এর পর) স্বাধীনতার পর গ্রামীণ হাট উন্নয়ন ও কৃষিপণ্য বিপণনের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব পায়। সরকার ও এনজিওগুলো হাট অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।

এভাবেই গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহস্রাধিক বছর ধরে সমৃদ্ধ করে তুলেছে গ্রামীণ হাট। যা পরিণত হয়েছে দেশের অর্থনীতির হৃদস্পন্দনে। সঠিকভাবে এর পরিচালনা, অবকাঠামো উন্নয়ন,এবং নীতি নির্ধারণ এবং বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা হলে  এটি গ্রামীণ উন্নয়নে আরও শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।

Jahan

×