শিক্ষকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এবং পরেও তাঁর শিক্ষাচিন্তার প্রতি আকৃষ্ট বিদেশী শিক্ষকের সংখ্যা অগণন। এক জাপানেই অনেকশিক্ষকও শিক্ষাবিদ কবিগুরুর শিক্ষাচিন্তা দ্বারা গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ১৯১৩ সালে এশিয়ায় প্রথম নোবেল বিজয়ী হওয়ার পর থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত, জাপানের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তায় আকৃষ্ট হয়ে লিখেছেন, এমনকি, শান্তিনিকেতন পর্যন্ত গিয়েছেন। তাঁরা শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রবীন্দ্র শিক্ষাচিন্তাকে প্রাকৃতিক এবং সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে উৎকৃষ্ট মনে করেছিলেন।
প্রথমত, প্রকৃতির উন্মুক্ত পরিবেশ থেকে প্রাণশক্তি আহরণ। এ ক্ষেত্রে আধুনিক যুগে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পথিকৃৎ। যে-কারণে বিশ্বখ্যাত শতবর্ষী সেইন্ট লিউক হসপিটাল, জাপানের প্রাক্তন প্রধান চেয়ারম্যান স্বনামধন্য চিকিৎসক ড. হিনোহারা শিগেআকি রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রকৃতি বিজ্ঞানী’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, সর্বজনীন বা বিশ্ববান্ধব হওয়া। এ জন্য বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতিকে অনুধাবন করা জরুরী। এই জন্যই কবিগুরু ১৯২১ সালে ব্রহ্মবিদ্যালয়কে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেছিলেন, যাতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ-তরুণীদের সম্মিলন ঘটে সেখানে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্বে জাপানে প্রথম রবীন্দ্র জাগরণ ঘটে। তাতে যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছিলেন,তাঁদের একটি বড় অংশ ছিল শিক্ষক, প্রশিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁরা ছিলেন প্রাচ্যচিন্তায় ঋদ্ধ, জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা ভারতের জাতীয়তাবাদী মনীষী হিসেবে অনুসরণ করতেন।
যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত জাপানে আবার রবীন্দ্র-জাগরণ ঘটেছিল। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত প্রভাবশালী শতাধিক জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। যাঁদের মধ্যে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, অধ্যাপক ও গবেষক অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সংখ্যায়ও ছিলেন অধিক। যুদ্ধে জাপান পরাজিত হলেও জাতীয়তাবাদ একেবারে নিস্তেজ হয়ে যায়নি।
প্রাচ্যাদর্শী জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ বিভ্রান্ত ছিলেন, কী হবে জাপানের ভবিষ্যত শিক্ষানীতি ও আদর্শ? কমিউনিস্ট পার্টির প্রবল প্রতাপ তখন। পুঁজিবাদী, যুদ্ধবাজ মার্কিনী চিন্তাধারা প্রভাবিত শিক্ষানীতি জাপানে চালু করার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। তার মধ্যেই যুদ্ধপূর্ব একদল রবীন্দ্রভক্ত বুদ্ধিজীবীর আহ্বানে মিলিত হন অনেক নবীন-প্রবীণশিক্ষক, অধ্যাপক ও গবেষক।
তাঁরা সংগঠিত হন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শততম জন্মবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে। জন্মবর্ষ উদযাপনের তিন বছর আগেই বিপুল পরিকল্পনা নিয়ে ১৯৫৮ সালে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। গঠিত হয় ‘তাগো-রু কিনেনকাই’ বা ‘টেগোর মেমোরিয়াল এ্যাসোসিয়েশন’, যার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের বন্ধু শিক্ষাবিদ ও পুঁজিপতি ড. ওওকুরা কুনিহিকো।
যুদ্ধপূর্ব সময় থেকে ভারতের সঙ্গে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভাববিনিময় সম্পর্ককে পুনরুদ্ধার এবং রবীন্দ্রনাথের প্রাচ্যদেশীয় শিক্ষাভাবনাকে জাপানে প্রচলিত করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্ররচনাকে পাঠ্যবিষয় করে পাঠদানের কার্যক্রমও চালু হয়েছিল।
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, টোকিওস্থ তামাগাওয়া গাকুয়েন বিদ্যালয়ে (১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে প্রসিদ্ধ তামাগাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়) শান্তিনিকেতনের আদলে শিশুশিক্ষার সূচনা করেছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ ড. ওবারা কুনিয়োশি। যুদ্ধোত্তর তাঁর প্রতিষ্ঠানের সবুজ বনজ প্রাঙ্গণে শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা চালু করেছিলেন। জাপানে ‘নতুন শিক্ষা পদ্ধতি’র অন্বেষক ও প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত ড. ওবারা যৌবনে গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে তাঁর এক রচনায় তিনি বলেছেন :
‘তেরাকোইয়া যা ভারতের আশ্রমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো। এই তেরাকোইয়ার একজন শিক্ষকের পৌত্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষাবিদ হওয়াই ছিল আমার জন্য ভাগ্যনির্ধারিত। এর জন্য আমি গর্বিত। যথার্থভাবে বললে বলতে হয়, এই ধরনের তেরাকোইয়া শিক্ষার মধ্য থেকেই জাপানের আধুনিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। এটা ছিল বর্তমান পদ্ধতিগত, কারিগরি কিংবা মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষার চেয়ে ভিন্ন।
আমার পরীক্ষামূলক তামাগাওয়া গাকুয়েন বিদ্যালয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা তার ভিত্তি হচ্ছে গভীর প্রাচ্যদেশীয় আধ্যাত্মিক চিন্তা, যদিও পাশ্চাত্যের উত্তম সংস্কৃতিও আমরা গ্রহণ করছি। আমাদের মূল মন্ত্র হচ্ছে: ‘জেন্জিন’ বা ‘পরিপূর্ণ মানুষ’, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “গু ওফবধষ ড়ভ ঊফঁপধঃরড়হ” প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। এই কারণেই আমি তাঁর সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করি।
‘বুদ্ধের জন্মভূমি হিসেবে ভারতবর্ষ আমার মনে বহুদিনের এক স্বপ্ন কিন্তু পরিতাপের বিষয় এখনো সেখানে পদার্পণ করতে পারিনি। আমার সাধ একদিন আমি ভারততীর্থে যাত্রা করে বুদ্ধের পূতপবিত্র খোদিত বাণী এবং বিশেষ করে, শান্তিনিকেতন দেখব। আমি নিশ্চিত যে, যেখানে গিয়ে যৌবনে পঠিত রবীন্দ্রনাথের “জবধষরংধঃরড়হ ড়ভ খরভব”এর যে ছাপ আমার অন্তরে প্রোথিত রয়েছে, তাকে সংস্কার করে নিতে পারব, যা তামাগাওয়া বিদ্যালয়কে সমৃদ্ধ করার জন্য বিশেষ সহায়ক হবে।’
অবশ্য রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা তামাগাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং নাগাসাকি বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রচলনের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তামাগাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজী প্রবন্ধ পাঠ্য হিসেবে পড়ানোর সূচনা করেন এই প্রতিষ্ঠানেরই খ্যাতিমান অধ্যাপক, গবেষক, অনুবাদক এবং বৌদ্ধ ধর্ম বিশেষজ্ঞ ইনাজু কিজোও।
টেগোর মেমোরিয়াল এ্যাসোসিয়েশনের মাসিক মুখপত্র ‘সাচিয়া’ বা ‘সত্য’তে লিখিত তাঁর একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের কয়েক বছর আগে থেকেই তিনি প্রাচ্য দর্শন বিভাগের শ্রেণীতে রবীন্দ্রনাথ পড়াতে শুরু করেন। পাঠ্যক্রমে যথাক্রমে রবীন্দ্ররচনা “গু ঝপযড়ড়ষ”, “ঊধংঃবৎহ টহরাবৎংরঃু”র মূল গ্রন্থ টাইপ রাইটারের মাধ্যমে টাইপ করে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছিলেন।
যুদ্ধ পরবর্তী জাপানী সমাজে তরুণ প্রজন্মের মানসে প্রাচ্যভাবনার একটা লক্ষণ দেখা দেওয়ায় তিনি ভাবেন, প্রাচ্য দর্শনের অধিকাংশ জুড়ে আছে বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধদর্শন থেকে জ্ঞান আহরণ করাটা শিক্ষার্থীদের পক্ষে কঠিন হওয়ার কারণে রবীন্দ্র চিন্তাকে নির্বাচন করেন। কেননা রবীন্দ্রনাথ খুব সহজে অনুধাবন করা যাবে। রবীন্দ্রনাথই সক্ষম হবেন তরুণদের মনে প্রাচ্য আধ্যাত্মিকতার জাগরণ ঘটাতে।
অধ্যাপক ইনাজুর ধারণা দ্রুতই সত্যে পরিণত হয়। অনেক ছাত্রছাত্রী উপর্যুক্ত রবীন্দ্ররচনা পাঠ করে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের বিষয়বস্তু নিয়ে স্নাাতক পরীক্ষার অভিসন্দর্ভও লেখে। অনেকেই প্রফেসর ইনাজুর কাছে এসে রবীন্দ্র-প্রভাবে তাদের জীবন দর্শনে নতুন পরিবর্তনের কথা ব্যক্ত করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দিশাহীন সমাজে ভবিষ্যতের নতুন আলোর দিক-নির্দেশনা খুঁজে পেয়েছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোটেই কম ছিল না।
বন বনানীর সবুজ-শ্যামলিমায় পরিপুষ্ট তামাগাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শান্তি নিকেতনের সঙ্গে খুব মিল থাকার কারণে ‘জাপানের শান্তি নিকেতন’ নামে পরিচিত ছিল ষাট-সত্তর দশকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভিত্তি ‘শিক্ষণ’, তাই এই প্রতিষ্ঠানে তরুণ ছাত্র এবং ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দ্রষ্টারাই ছিলেন অধিক। তাঁদের লভ্য শিক্ষা যেন পরিপূর্ণ এবং উচ্চমানসম্পন্ন হয় সেই দিকটি বিবেচনা করে প্রফেসর ইনাজু পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছেন “¸ School” এবং “Eastern University”কে অগ্রাধিকার দিয়ে।
এই প্রসঙ্গে তিনি বলছেন : “রবীন্দ্ররচনাকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য শুধু এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ মর্যাদার পরিপূরক হিসেবে নয়, রবীন্দ্রনাথের নতুন একটি দিককে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যও কাজ করেছে। অতীতকাল থেকে জাপানে রবীন্দ্রনাথ বলতে কবি কিংবা ধ্যানি দার্শনিক জাতীয় যে সীমিত প্রতিচ্ছবি তাঁর সম্পর্কে মানুষের মনে বিদ্যমান ছিল, সেটাকে আরও বিস্তৃত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তাঁর সৃষ্ট কাব্য, দর্শন জীবনের মধ্যভাগের শিক্ষাবিষয়ক কর্মকা-ের ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে।
তাঁর এই প্রদৃপ্ত বাস্তববাদিতা নতুন ভারতের জন্মদানে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। যে কারণে ভারতীয়রা তাঁকে আজও গুরুদেব বলে সম্বোধন করে থাকেন। এই রবীন্দ্রনাথকে জানা, ভারতবর্ষকে জানার মধ্য দিয়ে জাপান-ভারতের নতুন যোগসূত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার অপরিহার্য কাজটি ছিল আমার চিন্তার বিষয়। এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে, তরুণ প্রজন্মের অন্তরের অভিপ্রায়ে আমার এই চিন্তা মিলে গিয়ে ফলপ্রসূ হয়েছে। সকলে তাদের নতুন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করেছে দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি।’
একই সময়ে রবীন্দ্রানুসারী প্রফেসর ইনাজুর মতো আরেক রবীন্দ্রানুরাগীর কথাও জানা যায়, তাঁর নাম ইয়ামাগুচি কিওশি। তিনি ছিলেন জাতীয় নাগাসাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং ইতালীয় সাহিত্যের গবেষক। মহাযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বক্তৃতার সংকলন পাঠ করে তাঁর নামের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন। ১৯৫৪-৫৫ সালে ইতালির রাজধানী রোম ভ্রমণকালে ট্রেভি শহরের পুরনো গ্রন্থবিতানে ইংরেজী ‘গীতাঞ্জলি’র একটি কপি আবিষ্কার করে বারংবার পাঠ করে এতই অভিভূত হন যে, গ্রন্থটিকে আকাশের লক্ষ-কোটি নক্ষত্রের মধ্যে এক বিস্ময়কর উজ্জ্বল তারকা বলে উল্লেখ করেন।
এমনকি, চিরতরুণ সৌন্দর্য ট্রেভির ঝর্নার সঙ্গেও তুলনা করে তৃপ্তিলাভ করেন। ‘গীতাঞ্জলি’ দ্বারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন তরুণ সমাজের দৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের দিকে নিবদ্ধ করার জন্য শ্রেণীকক্ষে রবীন্দ্ররচনা পড়ানোর সিদ্ধান্তে উপনীত হন। সেই তাগিদ থেকেই নির্বাচন করেন রবীন্দ্রনাথের ইংরেজী প্রবন্ধের সিরিজ থেকে বেছে নিয়ে “গু খরভব”এবং “গু ঝপযড়ড়ষ” দুটি প্রবন্ধ। তিনিও টাইপ-প্রিন্টার মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেন। এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন,
‘আমি নতুন বছরের (১৯৫৯) পাঠ্যসূচীতে আমার শ্রেণীকক্ষে ইংরেজী ভাষায় পাঠ্য হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজী সিরিজের প্রথম ভাগ থেকে “গু খরভব” এবং “গু ঝপযড়ড়ষ” পড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। ...গত বছরও একই বিষয় পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।... শ্রেণীকক্ষে যখন প্রথম রবীন্দ্রনাথের রচনা পাঠ করি তখন তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম।’
‘অ্যালডাস হ্যাক্সলি, বার্ট্রান্ড রাসেল প্রমুখের প্রবন্ধ পাঠ করার পর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ছাত্রদেরকে বলি-এই সকল লেখকদের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের নাম তোমাদের কাছে দূরের কেউ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু “গু খরভব” যখন পাঠ করে শোনালাম তখন ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথকেই যে আমাদের কাছের মানুষ ইউরোপীয়দের চেয়ে এবং উত্তমরূপে আমাদের মনে আবেদন সৃষ্টি করতে পারেন-এটা তারা অনুধাবন করতে পারল।
আমি শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীরা যাতে নিজেরা বক্তৃতা এবং আলোচনার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে পারে তার জন্য ছোট ছোট দলে বিভক্ত করি। তাদের মধ্যে একজন ছাত্র প্রবল আগ্রহ নিয়ে আমার কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন প্রবন্ধগ্রন্থ ধার করে নিয়ে গিয়ে পাঠ করে একটি প্রবন্ধ লিখে ছাত্র-সাময়িকীতে প্রকাশ করেছিল।’
‘রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ সৃষ্টি হয় চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের। রবীন্দ্রনাথের “গু ঝপযড়ড়ষ” রচনার মধ্যে শান্তিনিকেতনের শিক্ষাবিষয়ক আদর্শকে তুলে ধরেছিলেন- তা ছাড়া এই রচনার মধ্যে রসবোধ যেমন ছিল, তেমনি ছিল মনোরঞ্জক পাঠবিষয়।’
এই শিক্ষামূলক রচনার পাশাপাশি গীতাঞ্জলি থেকেও কবিতা পাঠ ও ব্যাখ্যা করে পড়ানোর কথা বলেছেন প্রফেসর ইয়ামাগুচি। তাঁর ধারণায়: ‘কবিতাগুলো যতই ছোট হোক না কেন প্রত্যেকটি কবিতাই সম্পন্ন। এগুলো কবির আধ্যাত্মিকতার এক-একটি স্ফটিক-প্রস্তর এবং গবেষণার ক্ষেত্রে মূল্যবান।’
উপর্যুক্ত রবীন্দ্ররচনাগুলো আজ বিস্মৃতপ্রায়। কিন্তু যুদ্ধোত্তর এবং যুদ্ধপরবর্তী জাপানি শিক্ষাবিদরা যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন, তেমনটি ভারতবর্ষে হয়নি।
উৎস: টেগোর মেমোরিয়াল এ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র মাসিক সাচিয়া (সত্য), প্রথম সংখ্যা, ১৯৫৯
ছবি: ১] ১৯১৬ সালে জাপানের সানকেইএন বাগানবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২] পাঠ্যবিষয় হিসেবে রবীন্দ্ররচনা
৩] মাসিক ‘সাচিয়া’য় প্রকাশিত অধ্যাপকদ্বয় ইনাজু ও ইয়ামাগুচির নিবন্ধ।